শেষের পাতা
হেলেনের দাপটে বেপরোয়া ছিল সিলেটের কয়েস
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে
১৪ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
সিলেটের আওয়ামী লীগ নেত্রী হেলেন আহমদ। বর্তমানে লন্ডনে পলাতক। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠ জননেত্রী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। সিলেটে দাপট দেখিয়েছেন এক তরফা। তার দাপটের কাছে অসহায় ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেই হেলেনের ব্যবসায়িক পার্টনার কয়েস পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। আগে সাদাসিদেই ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী হেলেন আহমদ। পার্টনার কয়েসই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই থেকেই হেলেনের জীবন রহস্যঘেরা। হেলেন থেকে আরও চতুর মিসবাউল ইসলাম কয়েস। হেলেনের সব অপকর্মের মূল নিয়ন্ত্রক তিনি। তবু থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে দাপটের সঙ্গে চলেন সিলেটে। হেলেনের যেকোনো বিতর্কিত ঘটনায় কয়েসই ঢাল হিসেবে দাঁড়াতেন। সেই কয়েসের এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে হেলেন পালিয়ে গেলেও তিনি প্রকাশ্যেই ছিলেন। হেলেনের যাবতীয় অপকর্মকে ঢাকার চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে শনিবার রাত ১১টার দিকে জিন্দাবাজার হেলেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশ কয়েসকে আটক করেছে। আটক নিয়েও নানা নাটকীয়তা। গ্রেপ্তারকালীন সময়ে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল কয়েসকে আটক করতে যায়। এ সময় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েস পুলিশকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিলেন। পুলিশ দাবি করে- তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। কিন্তু কয়েস নিজেকে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে বলেন, ঠিকানা দেখেন। আমি সেই ব্যক্তি কি না। পুলিশ ভোটার আইডি দেখে। পুলিশ সদস্যরা জানান, কয়েস আটকের সময় নিজেকে নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। প্রায় ১০ মিনিট বাদানুবাদের পর কয়েসকে পুলিশের ভ্যানে করে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় সাংবাদিকরা ছবি ও ফুটেজ তুলতে গেলে তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন তিনি। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ মামলার অনুসন্ধান করে। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানায়, কয়েসের বিরুদ্ধে মারামারি, হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা রয়েছে ৬টি এবং দক্ষিণ সুরমা থানায় ১টি। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাও ছিল বলে জানায় পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ওসি মো. জিয়াউল হক জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারকৃত কয়েস আওয়ামী লীগ নেতা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার বিকালে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। কয়েসের মূল বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বসন্তপুরে। তার পিতার নাম নিমার আলী। সে বর্তমানে নগরের বিমানবন্দর এলাকার বড়শালা এলাকার বাসিন্দা। এই বড়শালায়ই অবস্থান হেলেনের। সেখানে রয়েছে হেলেনের মালিকানাধীন আহমদ হাউজিং। নামে-বেনামে অনেক সম্পদ। সেগুলোর পাহারাদার কয়েস। হেলেনের দখল করা সম্পদ দখলে রাখা, আইনি লড়াই করা, ক্ষমতার দাপট দেখানো- সবই করতেন কয়েস। ফলে হেলেনের পাশাপাশি কয়েসও ছিলেন বিগত দিনের আলোচিত চরিত্র। হেলেনের নাম আসলেই আসে কয়েসের নাম। আর নাম আসার কারণও রয়েছে। হেলেনের সঙ্গে সম্পর্ক কি- এ নিয়ে এন্তার প্রশ্ন। অনেকেই বলেন; সর্ম্পক স্বামী-স্ত্রীর। কিন্তু কয়েস সবসময়ই এ অভিযোগ উড়িয়ে দিতেন। ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে তাদের সর্ম্পক রয়েছে জানান দিতেন। হেলেনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ চুপ। তবে তাদের বেপরোয়া জীবন নিয়ে নানা কানাঘুষা চলছে। জিন্দাবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রায় ২৫ বছর আগে যখন হেলেনের স্বামী ব্যবসায়ী রুহেল আহমদ নগরের জল্লারপাড় রোডে হোটেল ব্যবসা শুরু করেন, তখন ওখানে চাকরি নিয়েছিলেন কয়েস। এরপর সে হেলেনের কাছাকাছি চলে আসে। হেলেনের স্বামী রুহেল সম্পদ নিয়েও ছিলেন সমস্যায়। নানা ধরনের চাপ কাবু করেছিল তাকে। হোটেল ব্যবসা চালু করার কিছুদিনের মধ্যে রুহেল মারা যান। আর তখনই হেলেন হাল ধরেন স্বামীর ব্যবসায়। সঙ্গে কয়েসও। হেলেনের পার্টনার হিসেবে পুরো সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব পায় কয়েস। হেলেন নামে থাকলেও কয়েসই সব। ফলে হেলেনের সঙ্গে জমি সংক্রান্ত যত বিরোধ রয়েছে সবখানেই কয়েসের নাম জড়িয়ে আছে। আহমদ হাউজিং ও ওই এলাকায় জমি দখল নিয়ে এলাকাবাসী ও প্রবাসীদের দ্বন্দ্বের যাবতীয় নাটক মঞ্চস্থ করেন কয়েস। কয়েস গ্রেপ্তারের পর সরব হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। তারা জানিয়েছেন, নানা সময় হেলেনের ক্ষমতার দাপটে প্রবাসীসহ অনেককেই হয়রানি করেছে কয়েস। এ নিয়ে সিলেটে একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেও প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলে কোনো কাজ হয়নি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেকে আওয়ামী লীগ নেত্রী পরিচয় দিয়ে হেলেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এই সময়ে কয়েক একর ভূমিও তারা জোরপূর্বক দখলে নিয়েছে। এয়ারপোর্ট এলাকায় দখল করা ভূমিতে মোমেন ফাউন্ডেশনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় যারাই প্রতিবাদী হয়েছেন তাদের হুমকি, ধমকি দিয়ে সরিয়ে রাখা হতো। তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে। গত ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাতারাতি রূপ পাল্টে ফেলেন কয়েস। হেলেন পালিয়ে যায় দেশ ছেড়ে। কিন্তু কয়েস প্রথমেই নিজেকে ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা পরিচয় দিয়ে অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে। নতুন করে সিলেট জেলা ও মহানগর জামায়াত আমিরের ছবি পোস্ট করে শুভকামনা জানান। জামায়াতের নেতাকর্মীরা এ বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করায় সে হালে পানি পায়নি। এর আগে তিনি নিয়মিত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সকল অনুষ্ঠানের ছবি সংগ্রহ করে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। সম্প্রতি প্রতারক মিসবাউল ইসলাম জেলা ও মহানগর বিএনপি’র দায়িত্বশীল পদে থাকা অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছিল। তবে, কোথাও সে আশ্রয় পায়নি। এদিকে, সিলেটে দাপট খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী হেলেন ও কয়েসের নাম উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের তালিকায়। দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে হেলেন ও কয়েসের নানা দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা অবৈধ সম্পদ অর্জনের নানা বিষয় খতিয়ে দেখছেন। এসব বিষয় নিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে আইনি উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র।
পাঠকের মতামত
সে আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। কলেজে থাকাকালীন ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করত। সে ক্যাডার ছিল। ছাত্র লীগ -ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সমানে পিটাইত। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কোন একসময় সে আওয়ামী লীগ হয়ে উঠে। শুনেছি তার অনেক ক্ষমতা ছিল।