দেশ বিদেশ
বিএনপি’র দু’গ্রপের কোন্দল
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের রাউজান
জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
২৩ মার্চ ২০২৫, রবিবাররাউজান উপজেলা হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর এক জনপদ। গত ৫ই আগস্টের পর ঘটেছে একের পর এক গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। রাত নামলেই ফাঁকা গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দিনে দুপুরে গুলি করে মারা হচ্ছে মানুষ। চলছে জমি দখল। নদী থেকে তোলা হচ্ছে বালু। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া হচ্ছে চাঁদা। চুন থেকে পান খসলেই হামলা হচ্ছে ঘরবাড়িতে। হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না মসজিদ মাদ্রাসাও। বিএনপি’র দুই নেতার অনুসারীরা কখনো নিজেরা লিপ্ত খুনোখুনিতে। আবার দুর্বল মানুষের ওপরও তারা চালাচ্ছে অত্যাচার। গত ছয় মাসে ৫ খুন আর অর্ধশত গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ কোনো অভিযান নেই।
সর্বশেষ নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের নোয়াজিশপুর গ্রামের ঈদগাঁ মাঠে ১৯শে মার্চ ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। আর এতে গোলাগুলির ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধ হন। আহত হন আরও অন্তত ১৫ জন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও উত্তর জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার অনুসারীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পাঁচটি মোটরসাইকেল ও একটি অটোরিকশায় আগুন দেয়া হয়েছে। গোলাম আকবর বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
এর আগে গত ২৪শে জানুয়ারি উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীর নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরের বাড়ি নোয়াপাড়ার নিরামিষ পাড়ায়। এ ঘটনায় তার আরও দুই সহযাত্রী আহত হয়েছেন। নিহত জাহাঙ্গীর নোয়াপাড়া এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারের মালিক এবং চট্টগ্রাম শহরের শুঁটকি ব্যবসায়ী।
গত ২১শে ফেব্রুয়ারি রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের গশ্চি ধরের টেক এলাকায় দু’টি প্রাইভেটকারে ৭-৮ জনের একটি অস্ত্রধারী দল এসে এক দোকানিকে গুলি করে এবং আরেকজনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটায়। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি একই ইউনিয়নের গরিব উল্লাহ পাড়ার মোহরম আলীর ছেলে সালেহ আহমদ (৪২)। তিনি একজন ডেকোরেশন ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় তার ভাগনে মুহাম্মদ জামশেদ (২৫)কে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। তাদের মধ্যে সালেহ আহমদ কপালে-পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। হামলার শিকার সালেহ আহমদ গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন তিনি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী। গোলাম আকবর খন্দকারের লোকজন তাদের ওপর হামলা করেছে। দু’টি প্রাইভেটকার নিয়ে এসে গুলি চালানো দলের প্রধান কথিত যুবদল নেতা আরাফাত মামুন খন্দকারের অনুসারী। পরে তাকে ও তার এক সহযোগীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ১৪ই নভেম্বর রাতে নোয়াপাড়ার নিরামিষ পাড়ায় দু’পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মুখোশ পরা অস্ত্রধারীদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এতে ১৫ জন গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হন। অস্ত্রধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নোয়াপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক মুহাম্মদ সাগর ও ওই ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদ পারভেজও গুলিবিদ্ধ হন।
ঘটনার শুরু ১৮ই আগস্ট থেকে
রাউজান উপজেলায় বিএনপি’র দু’গ্রুপে প্রথম হানাহানি শুরু হয় গত ১৮ই আগস্ট। ওইদিন উপজেলার চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের জিয়া বাজারে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা মিছিল বের করে। এ সময় তারা হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক ছোটন আজম বলেন, গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীরা লাঠিসোটা ও হকিস্টিক নিয়ে তাদের ওপর হামলা করেছে। এর দু’দিন পর নোয়াপাড়ার পথেরহাট বাজারে গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীরা পথসভা করেন। সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাদের ওপর হামলা হয়।
গত বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর নোয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় থেকে গোলাম আকবরের অনুসারী উপজেলার দুই ছাত্রদল নেতা জয়নাল আবেদীন ও মুহাম্মদ সাজ্জাদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মারধর করে হাত-পা বেঁধে নদীর চরে মৃত ভেবে তাদের ফেলে রেখে যান হামলাকারীরা। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তি ছিল। এ ঘটনার পর এলাকাছাড়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলা, মামলার শিকার হয়ে এলাকায় যেতে পারেননি তিনি। আর এখন যেতে পারছেন না গিয়াসের অনুসারীদের কারণে। এ ঘটনায় জয়নালের বাবা শওকত আলী বাদী হয়ে রাউজান থানায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
এ ছাড়া, ১২ই সেপ্টেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিমকে গ্রেপ্তার করা হলে রাউজানের পথেরহাট বাজারে আনন্দমিছিল বের করেন গিয়াস উদ্দিন কাদেরের অনুসারীরা। ওই মিছিলে হামলায় উপজেলা যুবদলের নেতা সুজন আচার্যসহ ১০-১২ জন আহত হন। এ ঘটনার জন্য আকবরের অনুসারীদের দায়ী করে মামলা হয়েছে।
প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি
রাউজানে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা আগের তুলনায় এখন কয়েকগুণ বেপরোয়া। কথায় কথায় গুলি ছুড়েন প্রকাশ্যে। আধিপত্য বিস্তার, ব্যবসা দখল এবং চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই এসব ঘটনা ঘটছে। প্রায় সব সন্ত্রাসীরাই একই কায়দায় অস্ত্র প্রদর্শন করছে। এর আগে রাউজানের নোয়াপাড়ায় অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। দু’টি ভিডিওতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক জানে আলম ও তার সহযোগীদের দেখা গেছে।
১০ই অক্টোবর নোয়াপাড়ার খায়েছ আহমদ চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় এক ভিডিওতে দেখা যায়, কামাল উদ্দিনের ঘরের সামনে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে তাক করতে উদ্যত হন জানে আলম। এর আগে ১২ই সেপ্টেম্বর কামালের বাড়ির গেটের সামনের রাস্তায় দোনালা বন্দুকসহ দেখা যায় জানে আলম ও তার কয়েকজন সহযোগীকে। পরে যৌথ বাহিনী ২রা ডিসেম্বর নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় থেকে জানে আলমকে গ্রেপ্তার করে। গত বছর ২২শে নভেম্বর বিকালে রাউজানে বিএনপি’র দু’পক্ষের হানাহানি, গোলাগুলি বন্ধের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন গ্রামের নারীরা। উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের গুহরক্ষিত পাড়া দয়াময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে কয়েকশ’ নারী ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা স্বাধীনতার পর থেকেই সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে এখানে এবিএম ফজলে করিমের কথাই ছিল ‘আইন’। কেউ তার কথার বাইরে গেলে তাকে পিটিয়ে আহত করা হতো। মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হতো। রাউজান উপজেলা বিএনপি’র অধিকাংশ নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় গেল দেড় দশকের বেশি সময় ধরে এলাকাছাড়া। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে তারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেন। তবে এলাকায় ফিরেই আধিপত্য বিস্তার, হামলা, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, বালুমহাল দখল, গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়েছে বিএনপি’র দু’টি পক্ষের নেতাকর্মীরা।
রাউজান থানার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি’র এসব হানাহানির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অনেকেই মামলা করেননি। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ১০টি। যদিও ৫ই আগস্ট থেকে ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত ৩০টির বেশি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২২টিই ঘটেছে নোয়াপাড়া ইউনিয়নে।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, আমরা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করছি। অস্ত্র উদ্ধারে সচেষ্ট আছি। যারাই আইন ভঙ্গ করবে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। আমাদের অভিযান চলমান আছে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছি। আগের তুলনায় রাউজানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভালো। তবে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে যদি গণ্ডগোল হয় সেখানে পুলিশের এখতিয়ার নেই। এটি নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা তাদের প্রোগ্রামগুলোকে কেন্দ্র করেও সতর্ক আছি।
গত ৫ই মার্চ উপজেলার পাহাড়তলী বাজারে অভিযান পরিচালনা করে আরাফাত মামুন ও বিপ্লব বড়ুয়া নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড কার্তুজ, ৫ রাউন্ড গুলি, এলজিসহ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তারা ২৪শে জানুয়ারি নোয়াপাড়ায় শুঁটকি ব্যবসায়ী হত্যা মামলার আসামি বলে জানা গেছে। আরাফাত মামুন যুবদলের নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও তার কোনো পদ-পদবি নেই। যদিও তিনি গোলাম আকবরের ছবি দিয়ে বিভিন্ন ব্যানার টাঙিয়েছেন। বিপ্লবও একই দলের রাজনীতিতে যুক্ত।
উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, গত বুধবার আমাদের নির্ধারিত ইফতার মাহফিল ছিল। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা ১০-১২টি মোটরসাইকেলে এসে ২০-২২টি অস্ত্র হাতে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তারা পূর্ব নির্ধারিত ইফতার মাহফিলটি পণ্ড করে দেয়। প্রায় ৪০০ মানুষ উপস্থিত ছিল ইফতার মাহফিলে। আমাদের ৭-৮ জন আহত হয়েছেন। একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। এখন কিছুটা উন্নতির দিকে। আমাদের কেউ কাউকে মারধর করেনি এবং কোনো গাড়িতে আগুন দেয়নি। তিনি বলেন, রাউজানে গোলাম আকবর খন্দকারের নেতৃত্বে বিএনপি’র পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। এর আগে আহ্বায়ক কমিটি কাজ করেছে। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অংশ চাচ্ছে সবকিছু ভেঙে দিয়ে কিছু একটা করতে। এজন্য তারা অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছে।
এ বিষয়ে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী চট্টগ্রাম উত্তরজেলা বিএনপি’র সদস্য আবু জাফর চৌধুরী বলেন, নোয়াজিশপুরের পাশের ইউনিয়নের চিকদাইরে আমাদের দলীয় ইফতার মাহফিল ছিল। সেখানে যাওয়ার পথে গোলাম আকবরের অনুসারীরা আমাদের কর্মীদের মারধর করেন। এ সময় আমাদের কর্মীদের ৫টি মোটরসাইকেলে আগুন দেন তারা। এ ছাড়া সন্ধ্যায় আমাদের কর্মীদের ওপর আবারো হামলা করা হয়। এতে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি আছেন। ইফতার মাহফিল নিয়ে এসব হানাহানি আমাদের কাম্য নয়। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারকে ফোন দেয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ক্ষুদে বার্তা দিলেও তিনি উত্তর দেননি। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, একসময় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ করা কিছু লোক এখন বিএনপি সেজেছে। তারাই পুরো রাউজানে ত্রাস সৃষ্টি করছে। আর আমাদের কতিপয় নেতা তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন। জানতে চাইলে বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব মূলত প্রশাসনের। এরপরও আমরা বিষয়টি নজরে রেখেছি। দলীয় শৃঙ্খলা নষ্ট করলে যে কারও বিরুদ্ধে দল অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেবে।