দেশ বিদেশ
ভুয়া র্যাব পুলিশের ডাকাতি উদ্বেগ
সুদীপ অধিকারী
২২ মার্চ ২০২৫, শনিবার
র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে একের পর এক ডাকাতি-ছিনতাইসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছেই। কোথাও দিনদুপুরে জনবহুল রাস্তা থেকে পণ্য বোঝায় ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথাও আবার বিমানবন্দর থেকে বিদেশ ফেরত যাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে লুট করা হচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয়ায় কেউ কথা বলারও সাহস করে না। এদের মধ্যে কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। তবে আসল আর নকলের ভিড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
ডিবি, পুলিশ ও র্যাব পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনা নিয়ে সৌদি প্রবাসী সাইফুল ইসলাম, লিয়াকত, কাতার প্রবাসী মো. মাসুদ, লন্ডন প্রবাসী মিজানুর রহমান, আরমানসহ বেশ কয়েকজন মানবজমিন’কে বলেন, আমরা যখন বিদেশ থেকে দেশে ফিরি তখন কিছু না থাকলেও পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের জন্য অনেক কিছু থাকে আমাদের কাছে। অনেকে স্বর্ণ, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপও নিয়ে আসেন। অনেক টাকা-ডলারও থাকে। আর ডাকাতদের টার্গেটই থাকে আমাদের মতো এই বিদেশফেরত যাত্রী। তাদের একটি দল মাইক্রোবাস নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষায় থাকে। আরেকটি দল এয়ারপোর্টের ভেতরে রেকি করে টার্গেটকৃত ব্যক্তি নির্ধারণ করে। পরে এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর সুবিধামতো স্থানে পৌঁছালে নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে পথরোধ করে থানায় যাওয়াসহ বিভিন্ন কথা বলে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরিয়ে মারধর করে সব লুট করে নির্জন জায়গায় ফেলে রেখে চলে যায়। ভুক্তভোগীরা বলেন, গভীর রাতে র্যাব-ডিবি পুলিশের জ্যাকেট পরা একদল লোক যদি আমাদের গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করতে চায় তখন কিছুই করার থাকে না। শুধু রাতে কেন দিনের বেলাতেও সাধারণ মানুষ যাচাই করার সাহস পায় না। আর এই সুযোগটাই তারা নেয়। তারা পুলিশের শুধু পোশাক না জিপ গাড়ি, হ্যান্ডকাফ পর্যন্ত ব্যবহার করে। তাই আশেপাশের লোক দেখেও ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এইসব অপরাধীরা কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক, গাড়ি, হ্যান্ডকাফসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র হাতে পায় তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। গত ৮ই মার্চ এমনই ঘটনা ঘটেছে প্রবাসী জসিমউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার বাড়ি কক্সবাজারে। দীর্ঘদিন তিনি ও তার দুই বন্ধু সালাউদ্দিন ও শহীদ দুবাই থেকে বিভিন্ন মালামাল এনে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসা করে আসছেন। দুই বছর আগে দুবাইয়ে পরিচয় হয় মিরপুর এলাকার সজীব নামে একজনের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে সজীব ব্যবসায় যোগ দেন। গত ৮ই মার্চ ভোরে তারা ৪ জন মালামাল নিয়ে দেশে ফেরেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি নিয়ে ঢাকা নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। নিউমার্কেটে বাসার নিচে পৌঁছালে পরিকল্পিতভাবে তাদের সঙ্গে আসা সজীবের সহযোগী একটি গাড়িতে আসা ৮/৯ জন পুলিশ, নৌবাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে দাবি করে থানায় যেতে বলে। এ নিয়ে প্রথমে তাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির পর জোর করে তিন বন্ধু সালাউদ্দিন, জসিমউদ্দিন ও শহীদকে বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মালামালসহ পুলিশের ব্যবহৃত একটি ডাবল কেবিন পিকআপ ও একটি প্রাইভেটকারে তুলে নেয়া হয়। ওইসময় অন্য গাড়িতে কৌশলে পালিয়ে যায় সজীব। এরপর তাদের থানায় না নিয়ে প্রাইভেটকারটি মিরপুর ও পুলিশের ব্যবহৃত ডাবল কেবিন পিকআপ পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়কের এক জায়গায় নিয়ে তাদের কাছে মুক্তিপণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে রাজধানী মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট ও পূর্বাচল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাই হওয়া বিভিন্ন মালামালসহ পুলিশে হেড কোয়ার্টারের চাকরিরত পুলিশ কনস্টেবল রুবেল, বরখাস্ত হওয়া পুলিশ কনস্টেবল কাজল ইসলাম, বরখাস্ত নৌ সদস্য রিয়াজুল জান্নাত, সিয়াদাত রাজ ও রহমত আলীসহ পাঁচজনকে আটক করে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। ওই সময় ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি পুলিশে ডাবল কেবিন পিকআপ, একটি প্রাইভেটকারসহ হ্যান্ডকাপ, ওয়াকিটকি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক জব্দ করা হয় বলে জানান রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ লিয়াকত আলী। আটক রুবেল পুলিশ হেড কেয়ার্টারে কর্মরত থাকায় সে ডাকাতির কাজে পুলিশের গাড়ি নিয়ে অংশ নিতো। ৭ই মার্চ র্যাব পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনায় রাজধানীর হাতিরপুল থেকে মো. আল আমিন হাওলাদার, মো. ওমর ফারুক, মো. ফারুক বেপারী, মো. শহিদুল ইসলাম শেখসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে নিউমার্কেট থানা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, র?্যাবের জ্যাকেট, হাতকড়া, হকিস্টিক, বেতের লাঠি, নগদ ৩০ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন ও কিছু প্রসাধনী সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। ঘটনা প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী মো. ফারুক মিয়া বলেন, গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক ২টার দিকে দুবাই থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছান। তিনি এয়ারপোর্ট থেকে একটি প্রাইভেটকারে করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিল দুবাই থেকে আনা ১০০ গ্রাম স্বর্ণের কয়েকটি চুড়ি, দুটি স্যামস্যাং এস-২৫ আল্ট্রা মোবাইল ফোন, একটি আইফোন ১২, একটি অ্যাপল ম্যাকবুক, একটি আইপ্যাড, একটি অ্যাপল ওয়াচ, তিনটি কম্বল ও বিভিন্ন ধরনের মালামাল। যার আনুমানিক মূল্য ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ফারুক মিয়া রাত আনুমানিক ৩টায় নিউমার্কেট হাতিরপুল রোডে তার বাসার সামনে পৌঁছালে তাকে অনুসরণ করা একটি কালো রঙের নোহা গাড়ি পথরোধ করে। এরপর গাড়ি থেকে র্যাবের পোশাক পরা ৫ থেকে ৬ জন নেমে নিজেদের র্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে ফারুক মিয়াকে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার সঙ্গে থাকা মালামালসহ তাকে তাদের গাড়িতে নিয়ে চলে যায়। এরপর ফারুক মিয়াকে তাদের গাড়িতে করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে হাতিরঝিল এলাকায় নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।
এদিকে রংমিস্ত্রির কাজসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় রেকি করে তথ্য সংগ্রহ করে পরে সুযোগ বুঝে র্যাব পরিচয়ে দলবল নিয়ে ডাকাতি করতো মোহাম্মদপুরের বিল্লু মিয়া। একাজে তারা বিদেশি অস্ত্রও ব্যবহার করতো। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে বিদেশি অস্ত্র ও গুলিসহ মো. বিল্লু মিয়া, তার চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-২ এর সদস্যরা। র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. খালিদুল হক হাওলাদার বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে র্যাব পরিচয়ে ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক কারবার ও সিএনজি ছিনতাই চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের দলে একাধিক নারী সদস্য রয়েছেন, যাদের ব্যবহার করে সিএনজিচালককে মারধরের পর গাড়ি ছিনিয়ে নেয়ার কাজ করতো।
গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের তেঘরিয়া আন্ডার পাসের নিচে থেকে র্যাব পরিচয়ে মো. রাসেল আহম্মেদ (৪৬) নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লুটে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
৮ ও ৯ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনায় মো. মঞ্জু, সাইফুল ইসলাম, মো. রাসেল, মো. জাহিদ, মো. জাকির প্রকাশ তৌহিদ, মো. ইসমাইল হোসেন, মো. হিরা শেখ, মো. রফিক, মো. বাঁধন, চাঁন মিয়া, বেল্লাল চাকলাদার ও মো. আসলাম খানসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯০০ লিটার সয়াবিন তেল, পরিত্যক্ত দুটি ট্রাক ও একটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২২শে জানুয়ারি রাত ৩টার দিকে একই কায়দায় ডাকাতদল মোহাম্মদপুর থানাধীন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গেটের সামনে থেকে ৭৫ ড্রাম সয়াবিন তেল বোঝাই একটি ট্রাক ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এরপর গত ৩০শে জানুয়ারি মগবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. মঞ্জু, সাইফুল ইসলাম, মো. রাসেল ও জাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে দীর্ঘদিন ধরে ডাকাতি করে আসছে বলে স্বীকার করেছে। এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, আমরা এ বিষয়ে অনেকবার জনগণকে সচেতন করেছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও বলেছেন- যদি কেউ আইনশৃঙ্খলা সদস্য পরিচয়ে আপনার বা আপনার প্রতিষ্ঠানের তল্লাশি করতে চায়, জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে আগে তার পরিচয়পত্র দেখতে চান। কারণ পুলিশ হোক আর র্যাব সদস্য সকলেই তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য। আর কেউ যদি পরিচয়পত্র না দেখাতে চায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী থানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন পুলিশের এই মুখপাত্র।