দেশ বিদেশ
সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমলো
ক্ষতিগ্রস্ত সীমিত আয়ের গ্রাহকরা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৪ জুলাই ২০২৫, শুক্রবারমুনাফার হার বাড়ায় আবারো সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছিল মানুষ; বিক্রিও বাড়ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার আগামী ছয় মাসের জন্য কমানো হয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১.৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯.৭২ শতাংশ। ১লা জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে। এর আগে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মেয়াদ পূরণ সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুসারে মুনাফার হার সর্বোচ্চ ১২.৫৫ শতাংশ করা হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
নতুন প্রজ্ঞাপনে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বেশির ভাগ সঞ্চয়কারী হলেন- অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক জনগোষ্ঠী। আবার অনেক নারী এ খাতে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের মাসিক খরচের বড় একটি অংশ আসে এ সঞ্চয়পত্র থেকেই। ফলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হার কমে যাওয়ার সিদ্ধান্তে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারী অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অথচ সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমানো হলো। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। ফলে সামগ্রিকভাবে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ আরও বাড়লো। বিশেষ করে যাদের পারিবারিক খরচের বড় একটি অংশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে আসে, তারা আরও চাপে পড়বেন।
দেখা যাচ্ছে, কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার তুলনামূলকভাবে বেশি। বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কম। এ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ পরিমাণ বা এর কম হলে সুদহার বেশি হবে। ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার কমে আসবে। আয় ও ঋণ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সরকার নিয়মিতভাবে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে।
দেশে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীন যত ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সঞ্চয়পত্রে এতদিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২.৫০ শতাংশ; এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১.৯৩ শতাংশ। আর সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে এ মুনাফার হার ছিল ১২.৩৭ শতাংশ, সেটা কমিয়ে ১১.৮০ শতাংশ করা হয়েছে। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পঞ্চম বছর শেষে, অর্থাৎ মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফা ছিল ১২.৫৫ শতাংশ; এখন তা করা হয়েছে ১১.৯৮ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ছিল ১২.৩৭ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৮০ শতাংশ।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২.৪০ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৮৩ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২.৩৭ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৮০ শতাংশ।
এ ছাড়া তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলেও মুনাফা কমবে। এ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২.৩০ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ মুনাফার হার ছিল ১২.২৫ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৭৭ শতাংশ।
এর বাইরে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মেয়াদি হিসাবেও মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হলে এবং সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১২.৩০ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৮২ শতাংশ। সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ১২.২৫ শতাংশ; এখন থেকে তা হবে ১১.৭৭ শতাংশ।
জাহানারা নামে একজন সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, আমার পেনশনের বেশির ভাগ টাকাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মাসিক ব্যয়ের বড় একটি অংশ আসে সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে। কিন্তু ১লা জুলাই থেকে নতুন সুদহার কার্যকর করা হয়েছে। এখন সুদ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, মুনাফার হার কমানো হলে যারা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেন, যেমন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তারা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে একদিকে যেমন তাদের আর্থিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে, অন্যদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহ ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত নীতিগত পুনর্বিবেচনার পাশাপাশি সরাসরি সহায়তা কিংবা সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি সমপ্রসারণ করা।