দেশ বিদেশ
মানবজমিনকে প্রো-ভিসি ড. মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চাই
মুনির হোসেন
২২ মার্চ ২০২৫, শনিবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. মামুন আহমেদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে সেটিকে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা। আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দেয়া। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তা যথাসময়ে যথাযথভাবে ব্যবস্থা করা। সেটি করতে পারলে শিক্ষকরা গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ হবেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের লাইব্রেরিকে তৈরি করেছি জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য উপযুক্ত আধুনিক বিশ্বের লাইব্রেরির মতো করে। আবার আজকাল যেহেতু অনেক কিছু আমাদের অনলাইনে পাওয়া যায়। প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতে পারলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণায় উৎসাহ তৈরি হবে। তখন হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা থেকে গবেষণার জন্য উদ্দীপনামূলক পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পারবো।
সম্প্রতি মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রো-ভিসি। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে, শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং, ছাত্ররাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। প্রফেসর মামুন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে পাঠদান ও গবেষণা। এটা ঠিক কিছু ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণের স্পৃহা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নেই। আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি সেক্ষেত্রে এটি অস্বাভাবিকও নয়। তবে আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে যারা অক্সফোর্ডসহ উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন সেখানে তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখতে পেরেছেন। একই ব্যক্তি বাংলাদেশে আসলে আর প্রোডাক্টিভ থাকছেন না। এর কারণ হচ্ছে গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমাদের প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করছে গবেষণার ক্ষেত্রে সে পরিবেশটা তৈরি করতে। সকল ক্ষেত্রে আমরা সফল হয়েছি এমনটা বলবো না। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে গবেষণার ফলাফলের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। যেটির প্রতিফলন বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা জয়েন্ট রিচার্স প্রোগ্রাম এবং ডুয়েল ডিগ্রি প্রোগ্রাম শুরু করতে উদ্যোগ নিয়েছি। শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে ওপেন ক্রেডিট সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ২০০। এর মধ্যে ১ হাজার শিক্ষক রয়েছেন যারা বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছে। তার মানে গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে যে বেসিক ট্রেনিং দরকার সেটি তারা অর্জন করেছেন উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
শিক্ষক নিয়োগের প্রাধান্যতার কথা উল্লেখ করে প্রো-ভিসি (শিক্ষা) বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অতীতে কিছু ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে এটা ঠিক। তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগে মেধাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকেই একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে ধরে নিই। মেধা বলতে একাডেমিক রেজাল্ট, গবেষণা অভিজ্ঞতা, শিক্ষকতা পেশার প্রতি দরদ ভালোবাসা রয়েছে কিনা। এগুলো বিচার করে আমরা শিক্ষক নিয়োগ দেই। আমি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা আরও কিছু জিনিস দেখি। সেগুলো হলো- সততা, নিষ্ঠা, ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেম এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। একজনকে নিয়োগ দেয়া হলো তিনি খুব ভালো পড়ান কিন্তু সততার মানদণ্ড পার হতে পারেন না, শিক্ষক হিসেবে যেসব গুণাবলি থাকার কথা সেগুলো তার নেই- তাহলে তো পরিবর্তনটা হলো না। এ ছাড়া কেউ যদি নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকে, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে থাকে তাদের বিরুদ্ধে যদি এরকম কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখেই নিয়োগ দেয়া হবে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই মেধাবীরাই যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসে।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে প্রফেসর মামুন আহমেদ বলেন, স্বৈরশাসনকে সহযোগিতা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলেনি বলে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। যেটি কিছুটা হলেও এখনো পর্যন্ত আছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ধীরে ধীরে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক উত্তরণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। ছয় মাস আগের থেকে এখন একটু ভালো অবস্থায় এসেছি। আশা করছি, সামনে আরও ভালো হবে। তবে স্বৈরশাসনের সহযোগী হিসেবে যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অভিযোগ এসেছে সেগুলোকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে সত্যানুসন্ধান কমিটি করা হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির প্রক্রিয়ায় পর্যন্ত আমাদের যেতে হয়েছে। এর মাধ্যমে যারা সত্যিকার অর্থে অপরাধী এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করেছেন তাদের চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রফেসর মামুন আহমেদ বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর একটি অস্থির সময়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছি। কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় ভেঙে পড়েছিল। এমতাবস্থায়, সিনেট, সিন্ডিকেটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটিউস অনুযায়ী বডিগুলো কার্যকর করা ছিল আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করা। যেটি আমরা ছাত্র-শিক্ষক সবার সহযোগিতা নিয়ে করতে পেরেছি। আমাদের প্রধান কাজ একাডেমিক ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়া। তিন মাসের মতো আমাদের একাডেমিক ক্ষতি হয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে এ ক্ষতিটা পূর্ণাঙ্গভাবে পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া, সেমিস্টার ও শিক্ষাবর্ষের সময় কমিয়ে আনা এবং পরীক্ষার মধ্যকার সময় কমিয়ে এনে একাডেমিক ক্যালেন্ডার পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
প্রথম বর্ষের শতভাগ শিক্ষার্থীর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর ফাইন্ড আউট করার চেষ্টা করেছি আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হওয়ার পর কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় এবং সেগুলোকে আমরা কীভাবে অ্যাড্রেস করতে পারি। আমাদের যে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় তার ৮০ শতাংশ আসে মফস্বল থেকে। এদের অনেকেরই আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাই নতুন শহরে এসে তারা হলে সিটসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। যখন তারা এ সহযোগিতা পান না তখন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যান। এখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ধরনের বৈষম্য, ক্ষোভ, সংকট তৈরি হয়। সে জায়গা থেকে আমরা দুটো উদ্যোগ নিয়েছি। আবাসনসহ ক্যাম্পাসের সব ধরনের সুযোগ- সুবিধা, সম্পূর্ণ মেধা, প্রয়োজনীয়তা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বণ্টন করা। আর হল পর্যায়ে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। হলগুলোতে এখন সিট বণ্টন থেকে সার্বিক কার্যক্রম হল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। অতীতের মতো অন্য শক্তির নিয়ন্ত্রণ নেই। এ ছাড়াও নতুন হল নির্মাণসহ শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন নতুন বৃত্তির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। ছাত্রীদের ক্ষেত্রে যাদের সিট দেয়া যাচ্ছে না তাদের আপৎকালীন সময়ের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা একটা বৃত্তি প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটি হচ্ছে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী শতভাগ আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। এটার জন্য সিন্ডিকেট থেকে একটা কমিটি করা হয়েছে। এটি এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। কার্যকর করতে পারলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এটি আমরা এ জন্য করছি- যাতে করে শিক্ষার্থীদের আর্থিক অনিরাপত্তার সুযোগ নিয়ে কেউ তাদের ব্যবহার করতে না পারে। এটা প্রয়োজন অনুযায়ী দেয়া হবে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি একশ’ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় সবাইকে আর্থিকভাবে নিরাপদ রাখতে চাই আমরা। এ একশ’ জনের মধ্যে ২০ জনের পারিবারিক সামর্থ্য আছে। তাদের ক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে না। ৩০ জন পূর্ণাঙ্গভাবে আর্থিকভাবে অনিরাপদ নয়, কিন্তু তাদের কিছুটা সহায়তার প্রয়োজন আছে। দুই হাজার টাকা সহায়তা পেলে তারা ভালোভাবে চলতে পারবে; তাদের জন্য সেই ব্যবস্থা করা। আর ৫০ জন যদি হতদরিদ্র হয় তাহলে তাদের আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে আর্থিক নিরাপত্তার মধ্যে নিয়ে আসবো। এক্ষেত্রে তাদের হলে সিট দেয়ার পাশাপাশি খাওয়ার জন্য অন্তত দুই হাজার টাকা দেয়া। আর যাদের সিট নিশ্চিত করা যাবে না তাদের জন্য বাইরে থাকা ও খাওয়ার জন্য একটা অর্থ দেয়া। আমাদের টার্গেট যাদের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োজন তাদের সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া। এ জন্য আমরা ফ্রেশার্স আন্ডারমেন্ড ফান্ড নামে একটি ফান্ড তৈরি করেছি। সিন্ডিকেটে প্রাথমিক কিছু সিদ্ধান্তও হয়েছে। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের (একাডেমিক) নেতৃত্বে একটা কমিটি করা হয়েছে। তারা কাজ করছে। আমরা প্রথমে চিন্তা করেছিলাম এ বছর থেকে শুরু করতে কিন্তু আমাদের এখানে কাজের কিছু শিথিলতা রয়েছে। এ বছর থেকে শুরু করতে পারলে ভালো হতো। আশা করছি, আগামী বছর থেকে কার্যকর করতে পারবো। সহায়তার ক্ষেত্রে কার কতোটুকু প্রয়োজন সেটি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডেমোগ্রাফিক ডাটা থেকে আমরা নিশ্চিত হবো। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদেরও অপশন দেয়া হবে সে কতোটুকু সহায়তা চায়।
ডাকসু এবং হল সংসদ নিয়ে প্রফেসর মামুন আহমেদ বলেন, ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল স্প্রিড হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সেই বিবেচনায় ছাত্রদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হয় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অংশ নেয়। সুতরাং ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনারই অংশ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দীর্ঘদিন এ নির্বাচন না হওয়ায় এক ধরনের ব্যাকলগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কার্যক্রমের মতো ডাকসু নির্বাচনটাও একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অংশ হিসেবে নিয়মিত অনুষ্ঠিত করতে। এ কাজটি করার জন্য কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আগে থেকে হয়ে আসলে প্রস্তুতি নিতে হয়তো সময় কম লাগতো। আমরা এটা এমন নিখুঁতভাবে করতে চাই যেন শুরু করে আবার পেছনে না আসতে হয়। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তিনটা কমিটি করেছে। অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে কমিটির প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেলে আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করবো। আমাদের রোডম্যাপের প্রধান উপাদান থাকবে ডাকসু নির্বাচন আমরা কখন, কীভাবে এবং কোন পদ্ধতিতে করতে চাই। একাডেমিক ক্যালেন্ডারের কোন সময়ে করলে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমে কোনো বাধা হবে না। এটি আমরা এমনভাবে তৈরি করবো যেন নির্বাচনটা একাডেমিক ক্যালেন্ডারের মধ্যে প্রতিবছর নিরবচ্ছিনভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজ করতে চাই। তাড়াহুড়ো করে অপরিণামদর্শী কোনো কাজ করতে চাই না। কারণ ডাকসু নির্বাচনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও সোশ্যাল অ্যাক্টিভিটিকে আপহোল্ড করবে।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তিনি বলেন, বিগত সময়ের অভিজ্ঞতার কারণে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এটি দেশবাসীর মধ্যেও আছে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন, পাঠন ও শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করবে না- এমন যেকোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধা থাকার কোনো কারণ নেই। তবুও যেহেতু সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে প্রশ্ন এসেছে সেহেতু বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আমরা একটা কমিটি করে দিয়েছি। সেই কমিটি সুপারিশ করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কীভাবে চললে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রমটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোনো প্রকার সাংগঠনিক কার্যক্রমের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সাধারণ জীবনযাপন যেন ব্যাহত না হয় সে ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরের (একাডেমিক) দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভারওল শিক্ষকতা ও গবেষণা দেখভাল, পরিকল্পনা করা। উন্নতির জন্য কাজ করা। এর পাশাপাশি র্যাঙ্কিং নিয়ে কাজ করা। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর র্যাঙ্কিং কমিটিকে পুনর্গঠন করেছি। র্যাঙ্কিংটাকে আমরা দুইভাবে ভাগ করি- একটা হচ্ছে টাইম হায়ার এডুকেশন র্যাংঙ্কিং, আরেকটা কিউএস র্যাঙ্কিং ও ইম্প্যাক্ট র্যাঙ্কিংয়ের জন্য। টাইম হায়ার এডুকেশন, কিউএস র্যাঙ্কিংয়ের জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করি। ইম্প্যাক্ট র্যাঙ্কিংয়ের জন্য আলাদা কমিটি গঠন করি। কমিটি গঠনের পর আমি তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। বছরব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অ্যাক্টিভিটি চলমান রয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ইম্প্যাক্টফুল কাজগুলো হয়, সেগুলো যথাযথভাবে রেকর্ডে রাখা এবং যথাসময়ে কম্পাইল করে সরবরাহ করাটা ছিল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এজন্য ফ্যাকাল্টি, বিভাগ, হল ও ইনস্টিটিউট লেবেলে সবার সঙ্গে লিংকেজ তৈরি করেছি। যাতে ওখানে যে ধরনের একাডেমিক ও রিসার্চ কার্যক্রম হয় তা যথাযথভাবে রেকর্ডেড হয় এবং রেকর্ডেড অনুলিপি যাতে যথাসময়ে আমাদের র্যাঙ্কিং অফিসে চলে আসে। একই সঙ্গে এর রিফ্লেকশন যাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ পায়। এর কিছুটা ফল ইতিমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো ইম্প্যাক্ট র্যাঙ্কিং পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করেছে। ফলাফল আমরা এখনো পাইনি, পেয়ে যাবো। আর কিউএস র্যাঙ্কিং এবং টাইম হায়ার এডুকেশনে ধীরে ধীরে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে। যেটুকু অগ্রগতি হচ্ছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। র্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কানেক্টিভিটি। ফরেন লুকটা আমাদের কেমন। এই জিনিসগুলো ইম্প্রুভ করার জন্য কাজ করছি। আমাদের ফরেন অফিসটা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জয়েন্ট ডিগ্রি, রিসার্চ, স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ, ফ্যাকাল্টি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি।
আমরা মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে আরও ভালো অবস্থানে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে আমাদের যা রিসোর্স রয়েছে তা ইউটিলাইজ করে কতো বেশি প্রোডাক্টিভ হতে পারি, সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখছি এবং নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এটি অব্যাহত রাখতে পারলে ভালো কিছু হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আইসোলেটেড প্রতিষ্ঠান না, এই সমাজেরই প্রতিষ্ঠান। এই রাষ্ট্রের অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় যে কার্যক্রম করে তা এই দেশের জন্যই করে থাকে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কে সবসময় সমাজের সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। সমাজের যা প্রয়োজন সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়, যুগোপযোগী করতে হয়। ইন্ডাস্ট্রি এর এমপ্লয়াবিটির জন্য প্রতিনিয়ত কোর্স কারিকুলাম আপডেট করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত যদি আমরা একে যুগোপযোগী করতে চাই তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজ ও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবে। সে জন্য প্রাক্তন ছাত্র থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি যাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ইতিবাচক ইনপুট নিয়ে কোর্স কারিকুলামসহ সবকিছু আধুনিকায়ন করতে। যেটা সত্যিকারার্থে সমাজ ও ইন্ডাস্ট্রির জন্য উপকারী হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজ ও ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে লিংকেজ তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলার ক্ষেত্রে অ্যালামনাইরা প্রধান ভূমিকা রাখে। আবার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক অর্থায়ন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সেদিকেও নজর দিতে চাই।
সাত কলেজ নিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২৪-২৫ সেশন থেকে আর সাত কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তি করবে না। এটা চূড়ান্ত। তবে যেসব ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে আছে তাদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান হচ্ছে তারা সনদ নিয়ে বের হওয়া পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রকার শিথিলতা করবে না। কিন্তু যারা নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হতে চান তাদের ক্ষেত্রে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটা কাঠামো তৈরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সে কাঠামোতেও রাতারাতি সব করে ফেলতে পারবে এমনটা নয়। সেক্ষেত্রে তারা যদি কোনো সহযোগিতা চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই সহযোগিতা করবে। পঠন, পাঠন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করবে। কিন্তু ওটা করতে গিয়ে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধায় কোনো রকম কম্প্রোমাইজ করবো না।
বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে ড. মামুন আহমেদ বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের রাজনীতি অন্যতম একটি ভূমিকা রেখেছে। এ অঞ্চলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। সেই নিরিখেই এ বিশ্ববিদ্যালয়টা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু একশ’ বছর পরও এ বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা ও গবেষণায় কৃতিত্বপূর্ণ অবকাঠামো থাকতে হয়।
গবেষণাকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যে অবকাঠামো, পরিকাঠামো, মানবসম্পদ থাকা প্রয়োজন সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মুহূর্তে আছে বলে মনে করি না। সত্যিকার অর্থে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একে প্রস্তুত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানটা সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পারে। আমার ধারণা আমাদের ছাত্রদের কোয়ালিটি অসাধারণ। শিক্ষকদেরও অধিকাংশ অত্যন্ত মেধাবী। তাদের শিক্ষা ও গবেষণার মান অনেক ভালো। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতা, মনোভাব, প্রত্যাশা, স্পিডের অভাব নেই। এটাই আমাদের বড় সম্পদ। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারলে আমি আমার দায়িত্ব তৃপ্তির সঙ্গে শেষ করতে পারবো।
পাঠকের মতামত
কিছুই হবে না।