প্রথম পাতা
কমিশনের সুপারিশ
নাখোশ ইসি
স্টাফ রিপোর্টার
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবারনির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ইসি’র স্বাধীনতা খর্ব হবে। ইসি সূত্র জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা ইসি’র অধীনে রাখাসহ মোট নয়টি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ঐকমত্য কমিশনকে অনুরোধ করেছে নির্বাচন কমিশন।
ইসি’র চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে কমিশন (ইসি) প্রতিহিংসার আশঙ্কায় শক্ত অবস্থান নিতে পারবেন না। এ ছাড়া সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে স্বাধীন কমিশন গঠনের বিরোধিতা করে নির্বাচন কমিশন চিঠিতে জানিয়েছে, ইসি নিজেই স্বাধীন এবং এটা ইসি’র সাংবিধানিক দায়িত্ব। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়েও নিজেদের মতামত জানিয়েছে ইসি। এ বিষয়ে ইসি বলেছে, আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা হলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগের বিষয়ে কমিশন জানিয়েছে, ইসি’র বিবেচনা অনুযায়ী সক্ষমতা ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে অনুশীলন করে নিয়োগ দিতে হবে। এদিকে সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ৪ মাসের মধ্যে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। এত কম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলে নিজেদের মতামত জানিয়েছে ইসি।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিজেদের অধীনে রাখার পক্ষে মতামত জানিয়েছে ইসি। ঐকমত্য কমিশনে পাঠানো চিঠিতে সংস্থাটি বলেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবার জন্য আলাদা কমিশন গঠন না করে এটি নির্বাচন কমিশনে রাখার পক্ষে ইসি। এ ছাড়া আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সশরীরে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার বিষয়ে ইসি বলেছে, সশরীরে জমা দেয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও জমা দেয়ার বিধান রাখতে হবে, তা না হলে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়েও নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে ইসি। সংস্থাটি বলছে, এটি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। ওদিকে সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, কমিশন ফলাফল গেজেট প্রকাশের পূর্বে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গণ-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একটি ঘোষণা প্রদান করবে। এ ছাড়া নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করতে হবে। সাংবিধানিক কাউন্সিল/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ কার্যদিবসের মধ্যে উক্ত অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। এই সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে নির্বাচন কমিশন বলেছে, এতে নির্বাচনকে অহেতুক প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এদিকে ঐকমত্য কমিশন বরাবর চিঠি পাঠানোর বিষয়ে ইসি’র জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে একটি স্বতন্ত্র কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, এর প্রয়োজন নেই। ইসি সচিব বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আসন সীমানা পুনঃনির্ধারণের যে ফর্মুলার কথা বলা হয়েছে, সেটি হলে শহরাঞ্চলে আসন বেড়ে যাবে। ইসি মনে করে, ভোটার সংখ্যা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিবেচনা করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা উচিত। ইসি সচিব বলেন, ভোটের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সার্টিফাই করার বিষয়ে একটি সুপারিশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন মনে করে, এর প্রয়োজন নেই। কারণ ফলাফলের যে গেজেট প্রকাশিত হয়, সেটাই সার্টিফিকেশন। নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও নির্বাচন কমিশনারদের শাস্তির বিষয়ে সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তাতেও ভিন্নমত রয়েছে। ইসি সচিব বলেন, রিটার্নিং অফিসার সন্তুষ্ট হয়েই ফলাফল ঘোষণা করেন। ভোটের পর তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে কমিশনারদের শাস্তির সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের আপত্তি তুলে ধরে আখতার আহমেদ বলেন, এজন্য একটি ব্যবস্থা এখনই রয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। যদি নির্বাচন শেষ হওয়ার পাঁচ বছর দশ বছর পর নির্বাচন কমিশনারদের আদালতে দৌড়াতে হয়, সেটি কি যৌক্তিক হবে? নির্বাচনে জয়ী হবেন একজন, বাকিরা সংক্ষুব্ধ হয়ে যেকোনো অভিযোগই করতে পারেন। এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের চিঠি আমি এখনো দেখিনি। তবে তারা যদি আপত্তি জানিয়ে থাকে সেগুলো আমলে নেয়া হবে। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
নতুন দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত ইসির গণবিজ্ঞপ্তি চ্যালেঞ্জ করে রিট: নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জারি করা গণবিজ্ঞপ্তি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম গতকাল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। আজ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে রিট আবেদনটির ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। রিটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের সচিব, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনকে বিবাদী করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, রিটে আমরা কয়েকটি বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করেছি। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য ইসির আইনে বলা আছে- রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ১০০ উপজেলা ও ২২ জেলায় দলের কমিটি থাকতে হবে। কিন্তু পাহাড়ি জনসংখ্যা অধ্যুষিত তিন জেলায় উপজেলা আছে মাত্র ২০টি। তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ইচ্ছা করলেও রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারবে না, এমনকি আঞ্চলিক দলও গঠন করতে পারবে না। ইসির বর্তমান আইন অনুযায়ী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে এ রিট করা হয়েছে। রিটে ইসির গণবিজ্ঞপ্তি বাতিলের নির্দেশনা চেয়েছি।
প্রবাসীদের জন্য প্রক্সি ভোটের বিকল্প দেখছেন না ইসি সানাউল্লাহ: এদিকে সব প্রবাসী যাতে ভোট দিতে পারেন, সেজন্য প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতিকে অধিক কার্যকর বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেছেন, প্রবাসীদের ভোটের জন্য অনলাইন, পোস্টাল ব্যালট ও প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের এখন মন্দের ভালো খুঁজে বের করতে হবে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেয়ার সুযোগ দিতে চাই, তাহলে কোনো না কোনো একটা অপশন বা সব অপশনের কম্বিনেশন আমাদের করতে হবে। আর বড় পরিসরে আমাদের প্রবাসীদের ভোট দেওয়াতে যদি চাই, তাহলে প্রক্সি ভোটিং ছাড়া আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কারণ বাকি যে দুটো বিকল্প রয়েছে- এগুলো পাইলটিং পর্যায়ে যাওয়া যাবে, লার্জ স্কেলে ডেপ্লয় হয়ত করা যাবে না। গতকাল নির্বাচন কমিশন ভবনে ওআইসিভুক্ত ১০ দেশের ১২ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন। ইসি সানাউল্লাহ বলেন, আমাদের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা আরেকজনের সহায়তা নিয়ে ভোট দিয়ে থাকেন। জমিজমাও পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, পোস্টাল ব্যালটটা বর্তমানে অকার্যকরী। অনলাইন পদ্ধতি নিয়ে আজও তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মিশরের রাষ্ট্রদূত জানালেন, তাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়, তারা চালু করে অনলাইন ভোট বন্ধ করে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেছেন, তাদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা ভালো, পূর্ণাঙ্গভাবে অনলাইনে চালুর অবস্থানে নেই তারা। আগামী এপ্রিলের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান ইসি সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করা হচ্ছে, মতবিনিময় হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ওআইসিভুক্ত দেশের মিশন প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আমাদের বর্তমান কার্যক্রম, গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব কাজ হাতে নিয়েছি, সেসব অবহিত করেছি। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটের ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা আশা করেছি। ইসি সানাউল্লাহ বলেন, প্রবাসী ভোট সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা তারা শেয়ার করেছেন। বিশেষ করে কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত সহযোগিতার বিষয়ে তাদের আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং অবজারভার টিম পাঠানোর জন্য। আমরা স্বাগত জানিয়েছি এবং যথাসময়ে এগুলো ফরমালাইজ করব। তিনি জানান, ইসির বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। বৈঠকে আলজেরিয়া, ব্রুনেই, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মরক্কো, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে মালয়েশিয়ার হাই কমিশনার মোহাম্মদ সুহাদা ওথমান বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের বড় সংখ্যক প্রবাসী রয়েছেন। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনি সংস্কারসহ সব সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন করছে মালয়েশিয়া। আমরা অভিজ্ঞতা শেয়ারে আগ্রহী, বিশেষ করে বিদেশি কর্মীদের অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়ে।
পাঠকের মতামত
বৈধ কাগজে যারা জাতীয় বাংলাদেশের আই,ডি কার্ড দেখতে পারবে এবং গত ফ্যাসিস্টরা যাতে অংশ গ্রহন না করতে পারে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।