দেশ বিদেশ
নবীগঞ্জে জাহাঙ্গীর হত্যা
মামলা তদন্ত না করেই প্রতিবেদন
স্টাফ রিপোর্টার, নবীগঞ্জ থেকে
১৭ মার্চ ২০২৫, সোমবার
নবীগঞ্জে চাঞ্চল্যকর জাহাঙ্গীর হত্যা মামলার প্রতিবেদন নিয়ে তোলপাড় চলছে। উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের কুর্শি গ্রামের দিনমজুর জাহাঙ্গীর খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান শিকদারকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী মোছাঃ রেজিনা বেগম। মামলাটি আমলে নিয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য হবিগঞ্জের জুডিশিয়াল আদালত-৫ এর বিজ্ঞ বিচারক গত বছরের ২১শে এপ্রিল হবিগঞ্জ সিআইডিতে প্রেরণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত বছরের ১লা জুলাই সিআইডি’র ইন্সপেক্টর মো. শফিকুল ইসলাম তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। মামলার তদন্ত নিয়ে অনেক নাটকীয়তা শেষে তিনি ঢাকা রেঞ্জে বদলি হন। বদলির পূর্বে মামলা তদন্তে লুকোচুরির আশ্রয় নেন। মামলার বাদী,সাক্ষী এমনকি ঘটনাস্থলে না গিয়েই কথিত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়কালে তদন্ত কর্মকর্তার অবস্থান তার মোবাইলে শনাক্ত করা যাবে। আর এতেই প্রমাণিত হবে তিনি ঘরে বসেই আদালতে দাখিলকৃত প্রতিবেদন তৈরি করেন। ওদিকে, তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের কথিত প্রতিবেদন গত বছরের ২৪শে ডিসেম্বর আদালতে দাখিল করেন সিআইডি’র উপ-পরিদর্শক মো. নয়ন মিয়া। সিআর মামলা নং ২৮৩/২৩। তদন্ত ছাড়াই প্রতিবেদন দেয়া নিয়ে এলাকায় তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ঘটনায় বাদী মোছাঃ রেজিনা বেগম আদালতে নারাজী দেয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন। চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। অভিনব ছলচাতুরিতে হতবাক বাদী পক্ষের আইনজীবী ও হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নির্মল ভট্টাচার্য্য রিংকু। তদন্ত প্রতিবেদন উদ্ঘাটনে তাকেও অনেক বেগ পেতে হয়েছে। আগামী ১৮ই মার্চ এনিয়ে শুনানির কথা রয়েছে।
সরজমিন ও মামলা সূত্রে প্রকাশ, কুর্শি গ্রামের মতিন মিয়ার পুত্র সিএনজিচালক নিহত জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান শিকদারের পোষ্য জনৈক লিটন মিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলায় সাক্ষী ছিল। এনিয়ে ক্ষুব্ধ লিটন ও মিজান শিকদারের নেতৃত্বে ২০২০ সালের ২১শে ডিসেম্বর তার ওপর হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে। ওইদিন বিকালে স্থানীয় বাংলাবাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে কুর্শি ষাটকাহনের মধ্যবর্তী স্থানে হামলা হয়। এ সময় রামদার কোপে তার একটি আঙ্গুল ঝুলে পড়ে। এ ঘটনায় জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান শিকদারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। বিজ্ঞ বিচারক মামলার এমসি রিপোর্ট পর্যালোচনায় নবীগঞ্জ থানাকে এফআইআর এর নির্দেশ দেন। জিআর মামলা নং ০২/২০২১। ওই মামলার বিচার সম্পাদনের মুহূর্তে আসামিরা বাদী জাহাঙ্গীরকে প্রলোভন ও হুমকি দেয়।
তবে জাহাঙ্গীর আপসে সম্মত হয়নি। একপর্যায়ে ২০২১ সালের ২০শে জুলাই উপজেলার বাউশা ইউনিয়নের গুইঙ্গিয়া জুড়ি হাওরের একটি ফিশারি পাহারা দেয়াকালে খুন হন জাহাঙ্গীর। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ উদ্ধারকৃত জব্দ তালিকায় এক টুকরো গামছার অংশ বিশেষ, একটা রশির অংশ, কিছু রক্তমাখা মাটি, ঘটনাস্থলের বারান্দা সংলগ্ন ঘর হতে আরও কিছু রক্তমাখা মাটি উদ্ধার করে। এসব আলামত নষ্ট করে তৎকালীন নবীগঞ্জ থানার জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা। বিপুল পরিমাণ টাকা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ভিসেরা রিপোর্টে গামছায় প্রাপ্ত রক্ত হতে ডিএনএ প্রোফাইলিং যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়নি। রক্তাক্ত মাটির স্তূপ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত ছিল না মর্মে মতামত দেয়া হয়। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনায় সত্যতা উদ্ঘাটনে সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আলামত ও রক্তাক্ত শরীরের ছবি ও বাস্তবতা আমলে না নিয়ে অফিসে বসেই প্রতিবেদন তৈরি করেন। মামলার আলামত নষ্টে তৎকালীন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আর মোটা অঙ্কের টাকায় চলে মামলার কারসাজি। কখনো হয়নি সরজমিন তদন্ত। তদন্তের অবস্থা জানতে গিয়ে বাদী, আইনজীবী এবং সাংবাদিককেও দেয়া হয় বিভ্রান্তিকর তথ্য। সাংবাদিকদের তরফে তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ এমনকি সরজমিন গিয়ে মেলেনি প্রকৃত তথ্য। বদলির কথা বলে সিআইডি’র নতুন এসআই নাসির উদ্দিন তদন্ত করছেন মর্মে বাদী ও সাংবাদিককে তথ্য দেয়া হয়। সরজমিন হবিগঞ্জ সিআইডি কার্যালয়ে গিয়ে এসআই নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অনেক তল্লাশি শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের সত্যতা নিশ্চিত করেন তিনি। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গত বছরের ২৪শে ডিসেম্বর আদালতে দাখিল করেন সিআইডির উপ-পুলিশ পরিদর্শক নয়ন মিয়া। অর্থের দাপটে আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান শিকদার ও তার সহযোগীরা দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনাহারে দিন কাটাচ্ছে দিনমজুরের পরিবার। এনিয়ে মামলার বাদী রেজিনা বলেন, জাহাঙ্গীর হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল বা কাউকেই কিছু না বলে গোপনে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ ঘটনায় আদালতে নারাজি দেয়া হবে। ভিসেরা প্রতিবেদন তৈরিতে কারসাজি ও প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানান মামলার বাদী ও হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধনে অংশ নেয়া স্থানীয় লোকজন।