প্রথম পাতা
এমসি’র তদন্ত রিপোর্ট, যে প্রশ্ন
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবারএমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তালামিযকর্মী মিজানুর রহমান রিয়াদের ওপর হামলার ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রিপোর্টে নির্যাতনের শিকার কলেজছাত্র মিজানুর রহমান রিয়াদ এই রিপোর্টে অনেক সত্য আড়াল করে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন। হামলাকারী অনেক শিবির নেতার নাম রিপোর্টে আসেনি বলে জানান। ঘটনা গত ১৯শে ফেব্রুয়ারির। সিলেট এমসি কলেজের আলোচিত শতবর্ষী ছাত্রাবাস। যে ছাত্রাবাস বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের মাঝামাঝি সময়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এ দিন হোস্টেলের ১১১ নম্বর কক্ষের ছাত্র ও তালামীযকর্মী রিয়াদের ওপর হামলা করেছিল ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। পরবর্তীতে তালামীয থেকে দাবি করা হয়- ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র এমসি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জাওহার মুসান্নার নেতৃত্বে ছাত্রশিবির কর্মীরা হামলা চালিয়ে রিয়াদকে গুরুতর আহত করেছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় সিলেটে। তবে শিবিরের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই ঘটনা অস্বীকার করা হয়। এই অবস্থায় ঘটনাটি যখন সিলেটে তুমুল বিতর্ক তখন সিলেট জামায়াতে ইসলামীর জেলা ও নগর নেতারা মীমাংসায় এগিয়ে আসেন। তারা আহত ছাত্রকে গিয়ে হাসপাতালে দেখে আসা ছাড়াও ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। জামায়াত নেতাদের এ ভূমিকায় সিলেট শিবিরের নেতারা বেঁকে বসেন। তারা ঘটনার দায় নিতে নারাজ। এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্ত রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে সবাইকে অনুরোধ করেন সিলেট মহানগর শিবির নেতারা। এমসি’র হোস্টেলের ঘটনায় জামায়াত ও শিবিরের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তির আভাস পাওয়া যায়। এই অবস্থায় পরবর্তীতে সিলেট নগর জামায়াতের আমীর মো. ফখরুল ইসলাম আগের দেওয়া বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশও করেন। যা জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। গত ৬ই মার্চ এমসি’র তদন্ত কমিটির নেতারা কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল কালাম মো. রিয়াজের কাছে রিপোর্ট জমা দিলেও সেটি প্রকাশ করা হয়নি। এমসি কলেজ তালামীযের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন- বুধবার রিপোর্ট দেয়ার বিষয়টি জানার পর তারা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেন এবং জানতে পারেন এমসি কলেজের তদন্ত রিপোর্টে কলেজ ছাত্রশিবিরের বিজ্ঞান সম্পাদক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন, সক্রিয় কর্মী নাজমুল ইসলাম নাঈম ও আব্দুল্লাহ আল আদনান, আব্দুর রহমান সোহাগ ও সাদমানকে সতর্ক করা হয়। ইসমাইল ছাড়া বাকি চারজনের পদবি অজ্ঞাত হলেও তারা শিবিরের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রীয় ছিলেন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও শীতবস্ত্র বিতরণ-২০২৫ কর্মসূচির ব্যানারে তাদের উপস্থিতির ছবি রয়েছে। আর ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে বিএ পাসের ছাত্র ও শিবিরকর্মী হৃদয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকে হোস্টেল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এদিকে রিপোর্ট জানার পর হতভম্ব হয়ে যান আক্রান্ত ছাত্র ও তালামীয নেতা মিজানুর রহমান রিয়াদ। তিনি গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ছাত্রশিবির সেক্রেটারি মোসান্না ও আরেক নেতা আরিফকে কোনো দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। অথচ ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন মোসান্না নিজেই। তবে উপস্থিত শিবিরকর্মীরা যাতে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার না করে এবং প্রাণে না মেরে ফেলে এজন্য মোসান্না সতর্ক ছিলেন। পরে তিনিই অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হাসপাতালে প্রেরণ করেন। রিয়াদ বলেন- তদন্ত কমিটির কাছে মোসান্নার কথা বলেছি। স্যারদের চাপের মুখে রাখা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা স্যারদের থ্রেটও দিয়েছে বলে শুনেছি। এ কারণে স্যাররা চাপের মুখে পড়ে তদন্ত রিপোর্টে পুরো সত্য তুলে আনতে পারেননি বলে দাবি করেন রিয়াদ। একই অভিযোগ করেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রিয়াদের রুমমেট জুনেদ আহমদ। তিনি জানিয়েছে- তদন্ত কমিটির কাছে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেটির কোনো প্রতিফলন রিপোর্টে আসেনি। অনেকটা বাধ্য হয়ে তদন্ত কমিটির নেতারা সত্য আড়াল করে গেছেন বলে মনে করেন তিনি। তার মতে; ঘটনার পর থেকে শিবির নেতারা হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। যার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষও নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেনি। তবে; প্রকাশিত রিপোর্ট শতভাগ সত্য বলে দাবি করেছেন এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল কালাম মো. রিয়াজ। মানবজমিনকে জানিয়েছেন- তদন্ত কমিটি কাজ করেছে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। তারা সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে যা পেয়েছেন এবং প্রমাণ যা হাতে পেয়েছেন তার আলোকেই রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি ভয়ের মুখে এমন তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেছে, সেটি মনে হচ্ছে না। এ কারণে রিপোর্ট প্রদানের পর কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়াও অন্যদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে কলেজ অধ্যক্ষ জানান- কলেজে কারা কোন দল করে সেটি কর্তৃপক্ষের কাছে বিবেচ্য নয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ সবাইকে ছাত্র হিসেবেই দেখে। এদিকে- হোস্টেলের ঘটনায় ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে শুরুতেই যে অবস্থান ছিল সেটি এখনো রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের এমসি কলেজের সভাপতি ইসমাইল আহমদ শুভ। তিনি জানিয়েছেন- তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তারা কেউ শিবিরের সঙ্গে জড়িত নয়। সূতরাং ঘটনার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না সেটিও কলেজ কর্তৃপক্ষের তদন্ত রিপোর্টে এসেছে। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে বিতর্কিত করতে শিবিরকে জড়ানো হয়েছিল বলে জানান তিনি। তবে- এমসি কলেজের হোস্টেলের ঘটনাটি ছাত্রলীগ স্টাইলে করা হয়েছিল বলে দাবি করেন আল ইসলাহ্র নেতা ও ফুলতলী পরিবারের সদস্য মাওলানা রেদওয়ান আহমদ ফুলতলী। তিনি বলেন- যখন জামায়াত নেতারা আমাদের ডাকেন, কাছে আসেন তখন আমরা যাই। এটাই সিলেটের ঐতিহ্য। মুরব্বী যা বলেন- অতীত থেকে সিলেটে তা পালনের রেওয়াজ আছে। এবার জামায়াতের নেতারা যেটি করেছিলেন সেটি ছিল সিলেটের রাজনৈতিক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু পরবর্তীতে ফের দুঃখ প্রকাশ সহ যেটি করা হয়েছে সেটি সিলেটের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সম্প্রীতির সঙ্গে বেমানান।
পাঠকের মতামত
জনাব ওয়েছ খছরু, আপনার মোবাইল নাম্বার দরকার।