প্রথম পাতা
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
পঙ্গুতে দিনে আসেন ২৬ জনের বেশি রোগী
মোহাম্মদ রায়হান
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবারপ্রতিদিনই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিসংখ্যান বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালটিতে দিনে ২৬ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিটোরের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯ হাজার ৭৯৯ জন। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৫ জন পুরুষ এবং ৭১৪ জন নারী।
দেশের অর্থোপেডিক চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত এই হাসপাতালটির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছর জানুয়ারি মাসে মোটরসাইকেলে আহত হয়ে মোট ৬৮৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, এর মধ্যে ৬৪১ জন পুরুষ এবং ৪৭ জন নারী। ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৬৩ জনের মধ্যে ৯০৩ জন পুরুষ এবং ৬০ জন নারী, মার্চে ৯৩০ জনের মধ্যে ৮৬৭ জন পুরুষ এবং ৬৩ জন নারী। এপ্রিলে ১ হাজার ৮৫ জনের মধ্যে ৯৯০ জন পুরুষ এবং ৯৫ জন নারী, মে মাসে ৮১৫ জনের মধ্যে ৭৪৩ জন পুরুষ এবং ৭২ জন নারী, জুন মাসে ৮৮৫ জনের মধ্যে ৮১৮ জন পুরুষ এবং ৬৭ জন নারী চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া জুলাই মাসে ৫৯০ জন পুরুষ ও ৫৮ জন নারীসহ মোট ৮৮৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন, আগস্টে ৫৪০ জনের মধ্যে পুরুষ ৫১৪ জন ও নারী ২৬ জন, সেপ্টেম্বরে চিকিৎসা নিতে আসা ৭১৬ জনের মধ্যে ৬৭৪ জন পুরুষ ও ৪২ জন নারী ছিল। আর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগী ও নারী-পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে- ৭৮১ জনে ৭৩৫ জন পুরুষ ও ৪৬ জন নারী, ৮০৯ জনে ৭৪৭ জন পুরুষ ও ৬২ জন নারী, ৯৩৯ জনে ৮৬৩ জন পুরুষ ও ৭৬ জন নারী।
সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন আব্দুর রহমান রাব্বি ও কারিমা আক্তার মিম দম্পতি। একইদিন রাজধানীর মিরপুরে বাইক দুর্ঘটনায় নাহিদ নামে একজনের মৃত্যু হয়। সম্প্রতি ডেমরায় মোটরসাইকেল ও কাভার্ড ভ্যানের দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী মাহমুদ বাবু ব্যাপারি নামে এক শিক্ষার্থী নিহত ও নিহতের বান্ধবী তনিমা আক্তার আহত হন। গত মাসে হাতিরঝিল মহানগর ব্রিজের ওপর দুই মোটরসাইকেল সংঘর্ষে আফজাল মোল্লা নামে এক যুবক নিহত হন। একই ঘটনায় ফুয়াদ হাসান নামে এক যুবক আহত হন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মহাখালী এলাকায় বন্ধুর বাইকে ঘুরতে গিয়ে ইমন নামে এক কিশোর নিহত হন। আহত হন তার বন্ধু রাফি।
নিটোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে পুরুষরা নারীদের চেয়েও ১২ গুণ বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। মোটরবাইকে আহত হয়ে এক বছরে হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে ৮ হাজার ৩৭১ জন বেশি।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে মোটরসাইকেলে। গত দুই বছরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে এবং এসব দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেলে ঘটা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া ৬ হাজার ৫২৪ জনের মধ্যে ২ হাজার ৪৮৭ জনই ছিলেন মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আহত হওয়া। যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ। একই বছর মোটরসাইকেলে আহত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪০৭ জন। ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশই ঘটেছে মোটরসাইকেলে। যেখানে নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৫৭০ জন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ১৫১ জন। আহত ও নিহতের পরিমাণ মোট নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত ১০ বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে বেড়ে ৬০ লাখ হয়েছে।
ঈদ ও বিভিন্ন উৎসব ঘিরে বেড়ে যায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা তখন ফাঁকা থাকায় সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোটরসাইকেল চালকরা। গত বছর ঈদে বন্ধুদের সঙ্গে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন সাভারের আশুলিয়ার হাবিবুল ইসলাম। রাস্তায় অন্য একটি মোটরসাইকেলকে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। ঈদের দিন মধ্য রাতে বন্ধু অমিতের সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে যান বরকতউল্লাহ জসিম। তীব্র গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক আহত হন দুই বন্ধু। পরে তারা ভর্তি হন পঙ্গু হাসপাতালে। শহরে ঈদের রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন সুমন হাওলাদার। ২০২৩ সালের ঈদে তিন বন্ধু- নিরব, লিমন ও সুমন মোটরসাইকেলে ছিলেন, এমন সময় একটি মাহেন্দ্র গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে নিরব ও লিমন মারা যান। ডান পা ভেঙে যায় সুমনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রায় ৩৫ লাখেরও বেশি মোটরসাইকেল চলছে। যা চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মোটরসাইকেল ব্যবহারে মনিটরিংয়ের অভাব, বেপরোয়া গতি এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-যুবকের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেয়া ইত্যাদি কারণে বেড়ে চলছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, সড়কগুলোতে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ হলো- প্রথমত সড়কে চলা যানবাহনগুলোতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, মোটরসাইকেল যারা চালায় তাদের একটা প্রবণতা থাকে কীভাবে আগে চলে যাওয়া যায়, কীভাবে অন্যগাড়িকে পার করে সামনে চলে যাওয়া যায়। অর্থাৎ তারা অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করে বেশি। ফলে তারা অনেক বেশি গতিতে চালায়। তৃতীয়ত, অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক আছে অথবা তরুণ যারা আছে তারা একটু বেশি গতি নিয়ে গাড়ি চালায়। তাছাড়াও মোটরসাইকেলের সঙ্গে সড়কে অন্য যে গাড়িগুলো চলছে তাদের সঙ্গে আবার সংঘর্ষ হয়, মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে সড়কে অন্য যানবাহনের চেয়ে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনার হারটাই সবচেয়ে বেশি হয়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ তাদের এক প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ তুলে ধরে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, গণপরিবহন উন্নত করা, সড়ক-মহাসড়কে সড়ক বিভাজক নির্মাণ করা এবং বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়ানো অন্যতম।