ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

চ্যালেঞ্জ উতরে সাতাশ পার করেছে মানবজমিন

লুৎফর রহমান
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবারmzamin

সাতাশ পেরিয়ে আটাশে পা রাখলো কোটি মানুষের প্রিয় দৈনিক মানবজমিন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রঙিন ট্যাবলয়েড বাংলা দৈনিক হিসেবে মানবজমিন-এর আত্মপ্রকাশ ছিল এক মহা চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে মানবজমিন সাতাশ বছর পার করেছে বুক চিতিয়ে। সত্যকে সত্য বলার অদম্য সাহস নিয়ে মানবজমিন দেশের গণমাধ্যমে নতুন এক ধারার সূচনা করেছে। মানবজমিন-এর পথ চলায় দেড় যুগ ধরে এর সঙ্গে আছি। প্রায় এক যুগ ধরে রিপোর্টিং বিভাগ সমন্বয়ের কাজ করছি। ২০১৩ থেকে ২০২৪-এর আগস্ট। কঠিন এক সময়। ২০১৩ সালের ৫ই মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নৃশংস ক্র্যাকডাউন। পরের
বছরের শুরুতে বিনা ভোটে সরকার গঠন। এই ভোটের পর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতন্ত্রী ধারা আরও শেকড় বিস্তৃত করার বহুমুখী চেষ্টা। সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী পরিকল্পনা। প্রবল চাপে গণমাধ্যম। একে একে বন্ধ হয়ে যায় দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ান, আমার দেশ। টিকে থাকা গণমাধ্যমগুলোর সামনে নানা চ্যালেঞ্জ। টিভি মালিকরা ক্ষমতার সঙ্গে আপস করে, কেউ কেউ স্রেফ ক্ষমতার নগ্ন দালালি করে টিকে ছিলেন দাপটের সঙ্গে। ছাপা কাগজের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। ক্ষমতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লড়াই জারি রেখে সত্য প্রকাশে অটল থাকা কাগজের সংখ্যা নেমে আসে এক হাতের আঙ্গুলেরও কম সংখ্যায়। এর মধ্যে মানবজমিন ছিল সবার উপরে। সত্য কে সত্য বলার কারণে এই সময়ে মানবজমিনকেই সবচেয়ে বেশি সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। মানবজমিনকে থামাতে সব চেষ্টাই করা হয়েছে। বছরের পর বছর সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ রেখেছে বহু প্রতিষ্ঠান। ডিএফপি’র তালিকায় আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকারও নিচে নামিয়ে দেয়া হয় মানবজমিন-এর নাম। সরকারি কোন সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়নি। গণভবনে প্রবেশের তালিকা থেকেও মুছে দেয়া হয়েছিল মানবজমিন-এর নাম। মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দুই বার দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। সত্য প্রকাশে আপসহীন মানবজমিন শত চাপে, চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সত্য প্রকাশে আপসহীন থেকেছে। সরকারের ভুলকে ভুল হিসেবে প্রচার করা, অনৈতিক ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের নির্দ্বিধায় সমালোচনা করেছে মানবজমিন। বিনা ভোটের সরকার গঠন, রাতের ভোট আর একতরফা ভোটের বিপক্ষে মানবজমিন ছিল সোচ্চার কণ্ঠ। গণতন্ত্রবিরোধী, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানবজমিন কণ্ঠ উচ্চকিত রেখেছে সর্বদা। মানবজমিন ক্ষমতার কাছের মানুষদের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকাশ করেছে। এসব কারণেই মানবজমিন ছিল ক্ষমতাসীনদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। গণভবন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চাটুকার কর্মকর্তারা মানবজমিনকে শাসানোর নানা ফন্দি করেছেন সময়ে সময়ে। কখনো সফল হয়েছেন আবার কখনো পারেননি। তবে তারা সমস্যা তৈরি করে গেছেন অবিরত।

মানবজমিন-এর একজন সুহৃদ ছিলেন প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী। তিনি মানবজমিন নিয়মিত পড়তেন। সংসদে দলের সভাপতির পাশে তিনি মানবজমিন পড়ছেন- এমন ছবি হরহামেশা দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও মানবজমিন পড়তেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনরা বলতেন। তারা বলতেন, শেখ হাসিনাও মনে করতেন মানবজমিন মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রকাশ করে না। কিন্তু মানবজমিন যা প্রকাশ করে তা হয়তো আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার পক্ষে যায়নি। এ কারণে তাদের ক্ষোভ ছিল, রাগ ছিল মানবজমিন-এর প্রতি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সময়ে সময়ে হয়েছে। এমনকি মানবজমিন বন্ধ করে দেয়ার  চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু সেটা আওয়ামী লীগ সরকার করতে পারেনি। না পারার কারণ মানবজমিন কোনো ভুল করেনি। কারও ফাঁদে পা দেয়নি। 
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শুধু সংবাদপত্রই নয় বিরোধী মতের সাংবাদিকরাও হয়রানি এবং হেনস্তার শিকার হয়েছেন সময়ে সময়ে। সংবাদ বা মতামত দেয়ার কারণে চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটেছে অনেকের। মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী চাকরি হারানো এমন বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে কাজের সুযোগ দিয়েছেন নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও। তাদের ‘আশ্রয়’ দেয়ার কারণে মানবজমিনকে নানা ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। নানা জায়গা থেকে প্রচ্ছন্ন হুমকি-ধামকিও আসে। 

আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দল দমনে যে পোড়া মাটির নীতি গ্রহণ করেছিল মানবজমিন ছিল তার ঘোরতর বিরোধী। গণতন্ত্রের নামে বিরোধী দল শূন্য পরিস্থিতি মানবজমিন সমর্থন করেনি। এ কারণে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে মানবজমিন। এসব খবরে গুরুত্ব দেয়ার কারণে মানবজমিনকে অনেকে বিএনপি বা বিরোধীদের কাগজ বলে রং দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানবজমিন বরাবরই প্রমাণ করেছে এটি কোনো দলের কাগজ নয়। এটি মানুষের কাগজ। দেশ এবং মানুষের জন্য একটি কাগজের যেমন ভূমিকা থাকা প্রয়োজন মানবজমিন সেই চরিত্র নিয়েই এগিয়েছে এবং এগোচ্ছে।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে মানবজমিন শুরু থেকেই সাহসী ভূমিকা নিয়েছিল। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানবজমিন যা ঘটেছে তা প্রকাশের চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন- নিপীড়নের চিত্র নির্ভয়ে তুলে ধরেছে মানবজমিন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণহত্যার চিত্র অকপটে তুলে ধরার কারণে শেষ মুহূর্তে মানবজমিন নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছিল হাসিনা সরকার। পতনের ঠিক একদিন আগে মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সাহসী সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী দেশ ছেড়ে গেলেও তার কর্মী ও অনেকের কাছে এই বার্তাটি ছিল অজানা। দুই একজনকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করেছিলেন। বলেছিলেন, যা হওয়ার হবে, নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করুন। যত ভয় দেখাক ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা লড়ে যাবো। ৫ই আগস্ট হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার তথ্য বাংলা গণমাধ্যমে প্রথমে প্রকাশ করে মানবজমিন। এদিন হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের খবর দিয়ে বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করে মানবজমিন। এটি আন্দোলন জয়ীদের হাতে হাতে পোস্টার হয়ে উঠেছিল ৫ই আগস্টের বিকালে।

অনেকে প্রশ্ন করেন, হাসিনার পতনের পর এখন মানবজমিন- এর ভূমিকা কী। মানবজমিন কী আগের অবস্থানেই আছে? 
হ্যাঁ মানবজমিন আগে যেমন ছিল এখনো তাই আছে। বরাবরের মতোই অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার মানবজমিন। মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে মানবজমিন কাজ করছে, কাজ করে যাবে। শেখ হাসিনার জমানায় দুর্বার ভূমিকা রাখা মানবজমিন বিপ্লব পরবর্তীতে কোনো সুযোগ সুবিধার ধার ধারেনি। সরকারি পদের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। আজীবন রিপোর্টিং-এর টেবিলে কাটানো মতিউর রহমান চৌধুরী এখনো খবরের সন্ধানে থাকেন সারাক্ষণ। তথ্য পেলে নিজের হাতে রিপোর্ট তৈরি করেন। মোজো আর মাল্টিমিডিয়ার যুগে এখনো যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা যায় তা তিনি বার বার দেখিয়ে দিচ্ছেন। প্রয়াত হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি করা সংবাদ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন-এর বয়ান প্রকাশ করে দেশ-বিদেশে আলোড়ন  তৈরি করেছিলেন। তেলবাজি আর সুবিধাবাদের সাংবাদিকতার বিপরীতে তিনি নিরপেক্ষতায় বিরল এক অবস্থান তৈরি করেছেন। 
কেবল সাংবাদিকতা করার কারণেই মানবজমিন বড় কাগজ হয়ে উঠতে পারেনি। মানবজমিন কর্মীদের মাইনে সময়মতো পরিশোধ করতে নিজেদের সম্পদ পর্যন্ত বিক্রি করেছেন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। নানা সময়ে প্রস্তাব আসলেও কোনো করপোরেট পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। 
শেখ হাসিনার জমানায় মানবজমিন সম্পাদক জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপিকা মাহবুবা চৌধুরীকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপনা করতে দেয়া হয়নি দীর্ঘ সময়। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখনো গুণী এই উপস্থাপিকাকে ডাকার গরজ বোধ করেনি বিটিভি কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবজমিন কোনো সময়েই মধুচন্দ্রিমায় ছিল না। দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবিলা করেই এগিয়েছে। মানবজমিন কারও তাঁবেদারি করেনি।

 

পাঠকের মতামত

এখানে উল্লেখ করা কোন কথায় অতিরঞ্জিত নয়। হাতের ১০ আঙ্গুলের মতই সহজ অঙ্ক। মানবজমিন জন্মলগ্ন থেকেই ব্যতিক্রমি ও ভিন্ন স্বাদের সংবাদপত্র। সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতা মেনে সংবাদ প্রকাশ এবং সাংবাদিকতা করা হাতে গোনা পত্রিকার একটি মানবজমিন। সম্পাদককে কখনও দেখিনি রাজ সভায় বসে সম্রাজ্ঞীর মনতুষ্টিতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে। আর মানবজমিন এর গেটাপ এক কথায় দৃষ্টিনন্দন। সত্যি বলতে মানবজমিন সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস একটি সংবাদপত্র। মানবজমিন এমনই থাক। শত বছর।

মোহাম্মদ আলী রিফাই
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ৬:৪৯ অপরাহ্ন

যুগ যুগ ধরে মানবজমিন এর নিয়মিত পাঠক আমি। অসত্য ও অন্যায়ের কাছে কখনও মাথানত না করা একটি পত্রিকা মানবজমিন। অফুরন্ত সময়কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকুক মানবজমিন। সাহসী সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর দীর্ঘজীবন কামনা করছি।

মুহাম্মদ ইসমাঈল বুখা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন

Love this newspaper

Giasuddin
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ৮:৫৩ পূর্বাহ্ন

মানবজমিন পত্রিকা এবং সাহসী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মতি ভাইকে প্রাণঢালা অভিনন্দন

Harun Rashid
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার, ১২:২৬ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status