প্রথম পাতা
আহতদের মুখে ঘটনার বর্ণনা
শুভ্র দেব
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রবিবারউন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী ওমর হামজা (২২)। শুক্রবার সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সঙ্গেই ছিলেন গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায়। তিনি এবং তার বন্ধুরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজে গাজীপুর জেলার সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। আড্ডা দেয়ার সময়ই তাদের এক সিনিয়র ভাইয়ের মোবাইলে ফোন আসে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালাচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। তাই প্রতিহতের জন্য তারা সবাই সেখানে চলে যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বাড়ির মেইন গেট বন্ধ করে তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে নেয়া হয় প্রথমে গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দিন হাসপাতালে। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হামলায় যারা আহত হয়েছেন তাদেরই একজন ওমর হামজা।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, ৭টা ৩৫ মিনিটের দিকে ফোন আসে। আমরা অনেকেই একসঙ্গে ছিলাম। ঘটনাস্থল থেকে আমরা ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের দূরত্বে ছিলাম। গত কিছুদিন ধরে কিছু ঘটনায় আমাদের জড়িয়ে সমালোচনা হচ্ছিল। তাই আমরা প্রতিহত করার জন্যই একসঙ্গে যাই। সেখানে পৌঁছানোর পর আমরা দেখি ৫/৭ জন ব্যক্তি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। যিনি ফোন করেছেন তিনি সেখানে ছিলেন। আনুমানিক ২২ বছর বয়সী এই যুবক নিজেকে শিক্ষার্থী বলে জানায়। আমরা প্রায় ৩৮ জন ছিলাম। যাওয়ার পরপরই আমাদের বলা হয় দোতলায় ভাঙচুর হয়েছে। তখন আমরা দেখতে পাই কয়েকটি থাই গ্লাস ভাঙ্গা। দোতলায় ভাঙচুর করা হয়েছে বলেও আমাদের জানানো হয়। আমরা যখন দোতলায় উঠি তখন বাইরে থেকে ভবনের প্রবেশপথের গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। নিচতলার একপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মেইন গেট আটকিয়ে দেয়ার পর এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় ডাকাতির উদ্দেশ্য দুষ্কৃতকারীরা ঢুকেছে। আপনারা সবাই আসুন। যখন তারা আগুন ধরিয়ে দেয় আমরা তখন বাঁচার জন্য ছাদের দিকে যাই। মাইকিংয়ের পরপরই এলাকার মানুষ আগুন নিভিয়ে দরজা ভেঙে উপরে উঠে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। যারা হামলা চালিয়েছে তাদের সবার হাতেই লোহার পাইপ, রড, লাঠি ছিল। যখন পরিচয় দিয়েছি আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তখন তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা চালিয়েছে। আমরা তাদেরকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা শিক্ষার্থী। কিন্তু তারা উল্টো বলতে থাকে তোরা ডাকাতি করতে আসছিস, তোদেরকে মেরে ফেলবো। এসব বলতে বলতে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তারা আমাদেরকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আমাদের সবার মাথায় আঘাত করেছে। তিনি বলেন, আমাদের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কারণ শুরুতে তারা ৫/৭ জন ছিল। কিন্তু ১০ মিনিটের ভেতরে কীভাবে তারা ৭০০/৮০০ অস্ত্রধারী হয়ে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর হামলা করেছে। কমিটি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বন্দ্ব থাকলে সেখানে শুধু শিক্ষার্থীরাই আসতো। কিন্তু সেখানে ৪০ ও ৫০ বছরের ঊর্ধ্বের কেউ থাকার কথা না। অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। ফোনকলের সত্যতা যাচাই না করে চলে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, এর আগেও দুই জায়গায় ভাঙচুর হয়েছে। সেখানেও আমাদের নাম জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা মনে করেছি সেখানে গিয়ে আমাদের প্রতিরোধ করা উচিত। যেন আমাদের নামে দুর্নাম না ছড়ায়। সে কারণে তাৎক্ষণিক ডিশিসন নিয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি। হামলায় আমাদের যুগ্ম আহ্বায়কও আহত হয়েছেন। তারা আমার মাথায় ব্যাপক আঘাত করেছে। কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বড় জখম রয়েছে।
আরেক ভুক্তভোগী আহত এসএসসি পরীক্ষার্থী আব্দুর রহমান ইমন (১৭) বলেন, আমি তখন আমাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। তখন যুগ্ম আহ্বায়ক হিমেল ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলেন সাবেক মন্ত্রীর বাসায় ঝামেলা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে হবে। আমি তখন ফোন পেয়েই বের হয়ে যাই। আমরা সবাই মিলে বাড়িতে প্রবেশ করার পরেই আমাদের ঘেরাও করে ফেলে গেট বন্ধ করে দেয়। মসজিদের মাইকে তখন ডাকাত প্রবেশ করছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কিছুক্ষণের ভেতরে লাঠিসোটা, রড নিয়ে আরও কয়েকশ’ মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে আমাদের ওপর হামলা করে। সবাইকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি। হাতেও কোপ লেগেছে। প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে আমি পালিয়ে আসি। নিজেই একটা রিকশা নিয়ে গাজীপুর সরকারি হাসপাতালে যাই। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর আমাকে এম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আমার মাথায় ৯টি এবং হাতে ৬টি সেলাই দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী আহত সাব্বির খান মিলন (২২) বলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা থাকাকালীন খবর আসে ঝামেলা হচ্ছে আমাদের সবাইকে সেখানে যেতে হবে। সবার সঙ্গে আমিও রওয়ানা দেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে কয়েকজন ছাড়া কাউকে দেখতে পাইনি। যখন তারা আমাদেরকে ভেতরে রেখে গেট আটকে দিয়ে মাইকে ঘোষণা দেয় তখন শ’ শ’ লোক রড, চাপাতি, পাইপ, লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরা তাদের অনেক বুঝিয়েছি আমরা শিক্ষার্থী। আমরা ডাকাতির জন্য নয় বরং প্রতিহত করার জন্য এসেছি। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা শুনেনি। যখন বলছি আমরা শিক্ষার্থী তখন তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালায়। চাপাতি দিয়ে আমাদের ইচ্ছেমতো কুপিয়েছে। সবার মাথায় আঘাত করেছে। আমরা ছাদে গিয়েও রক্ষা পাইনি। পরিকল্পিতভাবে আমাদের ফাঁদে ফেলে হামলা চালানো হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে মেরে ফেলা।
মর্নিং সান স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহত শুভ শাহরিয়ারের মা শিরিন বলেন, আমার ছেলেকে তার এক বড় ভাই নিয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রথমে তাকে কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন বিএনপি’র কমিটি দেয়ার জন্য একটা মিলাদ হবে। কিন্তু তাকে নেয়া হয়েছে মোজাম্মেলের বাড়িতে। শুভ সেখানে গিয়ে দেখে বাড়ি ভাঙচুর চলতেছে। পরে তারা ভেতরে ঢুকলে সবাইকে একটা রুমে আটক করে। কিছুক্ষণ পর মসজিদের মাইকে ডাকাত বলে ঘোষণা করা হয়। তখন তারা রুমের দরজা ভেঙে ছাদে যায়। ছাদের দরজা আটকে দেয়। কিছুক্ষণ পর তারা সবাই উপরে গিয়ে ছাদের দরজা ভেঙে তাদের আটকিয়ে মারধর করে।
আহত ইয়াকুব বলেন, যারা আমাদের ছাত্র প্রতিনিধি পরিচয় দিয়েছিল, তারা বলে যে ভেতরের অবস্থা খুব খারাপ। আপনারা একটু দেখেন। এ কথা বললে আমরা প্রায় ৩০ জন ভেতরে প্রবেশ করি। তারা চালাকি করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এরমধ্যে কয়েকশ’ ব্যক্তি আমাদের ওপর আক্রমণ করে। কিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। যাদের তারা ধরতে পারে তাদের মাথায় আঘাত করে, মাথা ফাটিয়ে দেয়। বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তারা আমাদের ওপর হামলা করে। এরপর তারা যাদের ভেতরে আটকিয়ে রেখেছিল, সেই গেট ভেঙে আমাদের ওপর হামলা করে। এ সময় আমরা পালিয়ে ছাদে চলে যাই এবং ছাদের গেট আটকিয়ে দেই। তিনি বলেন, তখন তারা মাইকে ঘোষণা দেয় যে মোজাম্মেল ভাইয়ের বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে। হামলা হয়েছে। মোজাম্মেল ভাইয়ের যত লোক আছেন সবাই এসে ওদের ধরেন। এভাবেই মাইকে একটা ঘোষণা দেয়। এরপর তারা ছাদের গেট ভেঙে আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা প্রত্যেককে দা, চাপাতি দিয়ে কোপানোর চেষ্টা করে। তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের ওপর নির্যাতন চালায়। এর মধ্যেই আমাদের কাছে যে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ যা ছিল, সব নিয়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের হত্যা করা। তারা আমাদের টর্চার করে চলে যাওয়ার পর লোকজন এসে আমাদের হাসপাতালে পাঠায়। আমাদের একজন প্রতিনিধি আইসিইউতে ভর্তি আছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গিয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় সে ব্যবস্থা করা হবে। এর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ছাত্রদের খোঁজখবর নেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন আইজিপি বাহারুল আলম ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার সাজ্জাত আলী। শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঢামেকের অর্থোপেডিক বিভাগ ও বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের ষষ্ঠ তলার ৬১৭নং ওয়ার্ডে আহতদের দেখতে যান উপদেষ্টা। এরপর পৌনে ১১টার দিকে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিলেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান। গাজীপুরের ঘটনায় ১৫ জন আহত হন। তাদের মধ্যে সাতজনকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়েছে। সরজমিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ভবনের ষষ্ঠ তলার ৬১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন গাজীপুরে হামলার ঘটনার আহত ৬ জন। সবারই মাথায় রয়েছে ব্যান্ডেজ। চলছে স্যালাইন। আহতদের কেউ কেউ বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। কেউ ঘুমাচ্ছেন। তবে কেউই ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। আহতরা ৬১৭ নম্বর ওয়ার্ডের ৬১৮, ৬১৯, ৬২০, ৬২১, ৬২৮ ও ৬২৯ নম্বর বেডে ভর্তি রয়েছেন।
পাঠকের মতামত
জুলুম বাজ সরকারের মন্ত্রীর বাড়ির জন্য মানুষের এত দরদ??? ২৪ এর এত রক্তের জন্য দরদ নেই?