বাংলারজমিন
সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারে নিহত ৪
‘মা-বাবা আর ভাই ঢাকা যাইয়া মইরা গেছে গা’
ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
১১ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবারমো. ফাহিম। বয়স ৯ বছর। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন ছোট। বাবা মায়ের ইচ্ছা ছিল কোরআনের পাখি বানাবে। বাবা-মায়ের ইচ্ছাতেই ফাহিম গোপালপুর তালবে এলিম হাফিজিয়া মাদ্রাসার বোডিংয়ে থেকে হেফজ পড়ছেন। ছোট্ট ফাহিম বিকাল পর্যন্তও জানতেন না সড়ক দুর্ঘটনায় তাকে এতিম করে, পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবেন পরিবারের সবাই। সঙ্গে একই পথের যাত্রী হয়েছেন তার আপন খালাও। গত বৃহস্পতিবার বিকালে ফাহিমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে চারটি লাশের খাটিয়া রাখা। পাশেই সামাজিক কবরস্থানে চলছে কবর খোঁড়ার কাজ। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন স্বজনরাও। এসেছেন এলাকাবাসীরাও। কিছুক্ষণের মধ্যে রবি নামে এক ব্যক্তি গোপালপুর থেকে ফাহিমকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন। উঠোনে চেয়ারে বসতে দেয়া হলো তাকে। ঘিরে ধরলেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা। গোটা উপজেলা জুড়ে চলছে তখন শোকের মাতম। একটি পরিবারের প্রস্থান। কি হৃদয়বিদারক ঘটনা। পাশ থেকে কেউ একজন ফাহিমকে জিজ্ঞেস করছে তোমার বাবা-মা আর ভাই কোথায়। জবাবে সে জানায়, ‘মা-বাবা আর ভাই ঢাকা গেছে। ঢাকা জাইয়া মইরা গেছে গা। লাশ আনতে গেছে মানুষ।’ কথাগুলো আদো আদো কণ্ঠে উত্তর দিলেও নদীর স্রোতের মতো দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরছিল অবুঝ ফাহিমের। পাশে থাকা স্বজন ও প্রতিবেশীরাও হাউমাউ করে কাঁদছিলেন তখন।
এতটুকুর বাইরে ফাহিমের মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হচ্ছিল না। মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। চাচি শিউলী বেগম বুকে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় ঘরে নিয়ে গেলেন সদ্য এতিম ফাহিমকে।
জানা যায়, গতকাল বুধবার রাতে সাভারে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তার বাবা ফারুক হোসেন সিদ্দিকী (৪৭), মা মহসিনা সিদ্দিকী (৩৬), বড়ভাই ফুয়াদ সিদ্দিকী (১৪) ও খালা সীমা খন্দকার (৩৮)। ফারুক তার পরিবার নিয়ে থাকতেন ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ভবনদত্ত গ্রামে। আর সীমা খন্দকারের বাড়ি পার্শ্ববর্তী গোপালপুর উপজেলায়।
বাবা ফারুক ছিলেন ভবনদত্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার ছোট ভাই মামুন সিদ্দিকী বলেন, তারা তিন ভাই এক বোন। বোন সবার বড়। ইতালি প্রবাসী। বড় ভাই ফারুক। সে স্কুল শিক্ষক। বড় ভাইয়ের ছেলে ফুয়াদ সিদ্দিকী স্থানীয় ভবনদত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন আমার বংশের বড় ভাতিজা। আর ছোট ভাতিজা ফাহিম সিদ্দিকী গোপালপুর উপজেলায় তালবে এলিম মাদ্রাসায় হোস্টেলে থেকে হেফজ পড়ছে।
মামুন আরও জানান, বড় ভাতিজা ফুয়াদ হঠাৎ করেই কিছুদিন থেকে অসুস্থ। শরীরে রক্ত কমে যায়। তবে ডাক্তার বলেছেন থ্যালাসেমিয়া নয়। বুধবার মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি গোপালপুরে যান ফুয়াদ। ওই রাতে হঠাৎ করে বাথরুমে গিয়ে পড়ে যায় ফুয়াদ। দ্রুত রাত ১১টার দিকে তাকে নিয়ে এম্বুলেন্সযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তার মা ও খালা। পথে উপজেলার হামিদপুর থেকে এম্বুলেন্সে ওঠেন বড় ভাই ফারুক সিদ্দিকী। মামুন জানান, রাতে আমার কাছে ফোন করে ফুয়াদের জন্য সবাইকে দোয়া করতে বলেন। এরপর আর কোনো কথা হয়নি।
নিহত ফারুকের চাচাতো বোন সোমা সিদ্দিকা বলেন, ভাইয়ের সঙ্গে রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার ফোনে কথা হয়। এরপর রাতে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সকালে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানান ঢাকায় পুলিশে কর্মরত নিহত সীমা খন্দকারের স্বামী।
নিহত ফারুকের সহকর্মী মো. রুবেল মিঞা বলেন, তিনি খুব নীতিবান লোক ছিলেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন জানান, রাতে তিনি ফারুক সিদ্দিকীকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে বাড়ি আসেন। এক সঙ্গে চা পান করেছেন। তার মতে এলাকায় ফারুক সিদ্দিকীর মতো ভালো মানুষ আর হয় না।
এ বিষয়ে কথা হয় নিহত ফারুকের ফুফাতো ভাই রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। ফারুক সিদ্দিকীসহ তার পরিবারের অন্য দুই সদস্যদের ঘাটাইলে তাদের সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। তবে সীমা খন্দকারকে তার বাড়ি গোপালপুরে দাফন করা হবে।
প্রসঙ্গত, বুধবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের ফুলবাড়িয়া পুলিশ টাউনের সামনে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এম্বুলেন্স ও দুইটি বাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে একই পরিবারের তিন জনসহ মোট চার জন নিহত হয়।