শরীর ও মন
ইরেক্টাইল ডিসফাংশন সমস্যার কার্যকরী সমাধান
সামসুল হক নাদিম
১৪ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবারইরেক্টাইল ডিসফাংশন কি: শারীরিক মিলনের পূর্বশর্ত হচ্ছে পুরুষাঙ্গের যথাযথ উত্থান অর্থাৎ সন্তোষজনকভাবে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য পুরুষাঙ্গের উত্থান একটি স্বাভাবিক আচরণ।
একজন পুরুষ যখন যৌন সম্পর্ক করার জন্য মনোশারীরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে তখন যদি পুরুষাঙ্গ সঙ্গমের জন্য উপযুক্তভাবে উত্থান না হয় তখন এটাকে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা বলে।
আমি যদি আরও সহজভাবে বলি, একজন পুরুষ ইন্টার কোর্স বা যৌন সম্পর্ক করার সময় যদি পুরুষাঙ্গ যথেষ্ট পরিমাণ শক্ত না হয় বা একেবারেই শক্ত না হয় কিংবা শক্ত হলেও কিছুক্ষণ পরে আবার নরম হয়ে যায়, এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেকোনো একটি যদি কমপক্ষে ৩-৬ মাস ধরে প্রায় প্রতিবার সহবাস করার ক্ষেত্রেই ঘটে তখন অবশ্যই ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা।
এ ছাড়াও যদি নিয়মিত আপনার ও আপনার পার্টনার বা সঙ্গীর ইচ্ছার চেয়ে দ্রুত সময়ে বীর্যপাত ঘটে অর্থাৎ যৌন সঙ্গম শুরু করার আগেই কিংবা যৌন সঙ্গম শুরু করার এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে আপনার বীর্যপাত ঘটে তাহলে বুঝতে হবে আপনার যে সমস্যাটি হচ্ছে তাকে প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন বলে।
কীভাবে উত্তেজনা ঘটে: পুরুষের যৌন উত্তেজনা একটি জটিল প্রক্রিয়া যার সঙ্গে মস্তিষ্ক হরমোন আবেগ স্নায়ু বা নার্ভ মাংসপেশী ও রক্তনালী জড়িত অর্থাৎ একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে আপনি যখন যৌন উদ্দীপক কোনো কিছু মনে মনে কল্পনা বা চিন্তা করেন, কোনো কিছু দেখেন বা শুনেন কিংবা আপনার যৌন সঙ্গীকে স্পর্শ করেন তখন আপনার ব্রেইন স্টিমুলেটেড হয়।
এর ফলে হরমোন এবং কিছু নার্ভের সম্মিলিত ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তনালিগুলো প্রসারিত হয় এবং পুরুষাঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। যার ফলে পুরুষাঙ্গ বেলুনের মতো ফুলে গিয়ে ইরেক্ট বা উত্থান হয়। এর যেকোনো একটিতে সমস্যা দেখা দিলেই ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা হতে পারে।
কেন হয়: ইরেক্টাইল ডিসফাংশন সাধারণত মানসিক এবং শারীরিক যেকোনো কারণেই হতে পারে তবে আজকাল অনেক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪৮ শতাংশ লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যার মূল কারণ ভাসকুলার বা রক্তনালীতে পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহ না পাওয়া বা নার্ভ সাপ্লাই কম হওয়া।
এ ছাড়াও শারীরিক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডায়াবেটিস, পুরুষ হরমোন টেসটোসটেরন লেভেল কমে যাওয়া এবং প্রোলেকটিন বেড়ে যাওয়া।
অপুষ্টি, অতিরিক্ত চর্বির আধিক্য বা হাইপারলিপিডিমিয়া, সিডেনটারি লাইফস্টাইল বা অলস জীবনযাপন, ইনসুমনিয়া বা দীর্ঘদিনের ঘুমের সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি কোমর ব্যথার কারণে নার্ভে চাপ লেগে থাকা এবং অনেক দিন যাবৎ ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, প্রোস্টেড গ্ল্যান্ড ও মানসিক রোগের ওষুধ সেবনের ফলেও ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা উত্থানজনিত সমস্যা হতে পারে।
৪০-৫০ বছর বয়সের পরে কেন বেশি হয়
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ বছরের পরে ৪০ শতাংশ, ৫০ বছরের পরে ৫০ শতাংশ এবং ৬০ বছরের পরে ৬০ শতাংশ পুরুষের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা উত্থানজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন।
এর কারণ মূলত দুটি- নাম্বার ওয়ান পুরুষ হরমোন টেসটোসটেরন কমে যাওয়া এবং দ্বিতীয়তো পুরুষাঙ্গের রক্তনালীর ভেতরে চর্বি জমে গিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্তের ফ্লো বা সারকুলেশন হতে না পারা, যার ফলে ভাসকুলার ইরেক্টাইল ডিসফাংশন সমস্যা দেখা দেয়।
অনিয়মিত কারণ: আজকাল প্রায়শই আমরা আমাদের চেম্বারে কিছু রোগী পাচ্ছি যারা হয়তো তিন থেকে চার বছর বা তারও বেশি দিন যাবৎ কাজের প্রয়োজনে পরিবার ছাড়া প্রবাসে থাকেন।
বিদেশে যাওয়ার আগে তাদের কোনো ধরনের উত্থানজনিত সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রবাসে থাকার এই দীর্ঘ সময়টাতে তারা ধর্মীয় পাপবোধ বা নৈতিক দিক কিংবা আর্থিক দিক চিন্তা করে কারও সঙ্গে কোনো যৌন সম্পর্কে মিলিত হয় নি।
দীর্ঘদিন পরে দেশে এসে এখন তার পার্টনারের সঙ্গে নিয়মিতই লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা ফেস করছেন।
যেটা মূলত অনিয়মিত যৌন সম্পর্ক বা লং সেক্সুয়াল গ্যাপ কিংবা এসেক্সুয়ালিটির কারণে পুরুষাঙ্গের টিস্যুগুলোতে রক্তপ্রবাহ বা সারকুলেশন কমে গিয়ে ইরেকশনের সঙ্গে রিলেটেড মাংসপেশীগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন হয়।
নির্ণয় প্রক্রিয়া: বয়স যদি ৩৫-৪০ এর উপরে হয় এবং আপনি যদি নিয়মিত ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা বা প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশনের সমস্যায় ভুগে থাকেন তাহলে কোনো প্রকার চিকিৎসা নেয়ার আগে অবশ্যই একজন বিশেষঙ্গ চিকিৎসকের পরামর্শে আপনার রক্তে টেসটোসটেরন ও প্রোলেকটিন হরমোন ঠিক আছে কিনা তা দেখে নেয়া উচিত।
এছাড়াও ডুপ্লেক্স স্টার্ডি অফ পেনাইল ভেসেলস কিংবা পেনিসের কালার ডপলার স্ক্যান পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ বা নার্ভ সাপ্লাই ঠিক আছে কিনা তা দেখে, যদি ভাসকুলার বা রক্তপ্রবাহজনিত কারণে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন থাকে তাহলে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।
ইরেক্টাইল ডিসফাংশন ভালো হয়: সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে যদি আপনি ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যার সঠিক চিকিৎসা না করেন তাহলে দীর্ঘস্থায়ী পুরুষত্বহীনতা বা পারমান্যান্ট ইমপোটেন্সী হতে পারে।
এ ছাড়াও দাম্পত্য কলহসহ বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেয় তাহলে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন সম্পন্নরূপে ভালো হয়।
আধুনিক চিকিৎসা: আমাদের দেশে একটি প্রচলিত মিথ বা ভুল ধারণা আছে, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা যৌন অক্ষমতার কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নাই তবে সঠিক কথা হচ্ছে সম্পূর্ণ কাটাছেঁড়া ছাড়া ব্যথামুক্ত ফোকাসড-শকওয়েভ থেরাপি ও মিনিমাল ইনভেসিভ পি-শট বা প্রিয়াপাস শট চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব।
ফোকাসড-শকওয়েভ থেরাপি যেভাবে কাজ করে: ফোকাসড শকওয়েভ চিকিৎসা যা একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পুরুষাঙ্গের বাহির হতে স্বল্পমাত্রার (০.২৭ মিঃলিঃ জুল পার মিঃমিটার এর নিচে) অভিঘাত তরঙ্গ বা জলতরঙ্গ দেয়া হয়। যা যান্ত্রিক কিন্তু বৈদ্যুতিক নয়।
চিকিৎসার এই পদ্ধতিতে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে শরীরের নিজস্ব পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নতুন টিস্যু তৈরি করতে সাহায্যে করে পুনরায় লিঙ্গ উত্থান হয়।
এই পদ্ধতিতে আমরা যেকোনো একজন রোগীর চিকিৎসার জায়গাটাকে প্রথমে পরিষ্কার করে পুরুষাঙ্গের বেইজ, শেফট ও পেরোনিয়াল এরিয়াতে ফোকাসড শকওয়েভ বা জল তরঙ্গ দেই।
যার ফলে পুরুষাঙ্গের ওই এলাকাতে সাইটোকাইনেজ বা সাইটোকাইনেসিস বলে একটা কেমিক্যাল থাকে তখন শরীরের যে পার্ট এ শকওয়েভ দেয়া হয় সেখান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত স্টিমুলেশন যায়।
ব্রেইন বা মস্তিষ্ক তখন আমাদের শরীরে থাকা এনজিওজেনিক ও নিউরোজেনিক গ্রোথফেক্টর যেমন- এপিথেলিয়াল নাইট্রিক এক্সাইড সিনথেস, ভেসেল এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথফেক্টর (ভেএজাফ), সেল প্রোলিফারেটিং ফেক্টর এবং বিশেষ ধরনের স্টেম সেল রিলিজ করে।
ফলশ্রুতিতে, এনজিওজেনেসিস মানে নতুন ব্লাড ভেসেল বা রক্তনালী প্রসারিত হয়ে রক্ত চলাচল বহুলাংশে বেড়ে যায় এবং নিউরোজেনেসিস মানে নতুন নার্ভ টিস্যুগুলোকে রিপেয়ার করে এবং পুনরায় ইরেকশন বা লিঙ্গ উত্থান হয়, যা পুরোপুরি নিরাপদ ও দ্রুত কার্যকর।
লেখক: কনসালটেন্ট, রিজেনারেটিভ থেরাপি প্র্যাক্টিশনার এডভান্সড সেন্টার ফর রিজেনারেটিভ থেরাপি-২০৬৬, এভারকেয়ার হসপিটাল লিংক রোড, বসুন্ধরা, ঢাকা-১২২৯। মোবাইল: ০১৯৭৭৬৫৬২৩৭, ওয়েবসাইট িি.িধপৎঃনফ.পড়স