প্রথম পাতা
অধরাই রয়ে গেল ইমতিয়াজের স্বপ্ন
ফাহিমা আক্তার সুমি
১১ নভেম্বর ২০২৪, সোমবারবিশ বছর বয়সী ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির। ঢাকার সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র শিক্ষার্থী ছিলেন। গত ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রামপুরায় গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাত দিন পর মারা যান। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিলেন বড়। তার বাবা নওশের আলী কৃষিকাজ করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে ঢাকায় এসেছিলেন জাবির। কিন্তু সেই স্বপ্ন নিভে গেছে চিরতরে। সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন এই বাবা-মা। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ইমতিয়াজের বোন। বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘবে হাল ধরতে চেয়েছিলেন ইমতিয়াজ। তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।
ইমতিয়াজের বাবা নওশের আলী মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলের কোমরের নিচে ডান পায়ে দুইটি গুলি লাগে। আমি কৃষিকাজ করলেও আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো। ইমতিয়াজের স্বপ্ন ছিল আমেরিকায় পড়াশোনা করবে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে অভাব দূর করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। অল্প বয়সে আমাদের রেখে চিরতরে চলে গেল। ও খুব মেধাবী ছিল। সারাক্ষণ পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। যশোর আকিজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। আমার স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমরা যশোর থাকি। ইমতিয়াজ বনশ্রীতে একটি হোস্টেলে থাকতো।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ১৯শে জুলাই বিকাল তিনটার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় ইমতিয়াজ। সেদিন একটা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হলে সেখানে থাকা অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিকাল চারটার দিকে তারা আমাকে ফোন করে খবর জানায়। ঢাকায় পৌঁছাই রাত দুইটায়। প্রথমে মুগদা মেডিকেলে গিয়ে সেখানে না পেয়ে শ্যামলীর হৃদরোগ হাসপাতালে যাই। ওই হাসপাতালে তিন দিন পর জ্ঞান ফিরে। একটি অপারেশনও হয় এবং পা কাটার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। তখন কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী ভর্তি নেয়নি। পরে আমাদের ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। সেখানে ভর্তির তিন দিন পর ওর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসক ডায়ালাইসিস করার কথা বলেছিলেন, আমরাও করতে বলেছিলাম কিন্তু যখন ডায়ালাইসিস করার কথা ছিল তখন করেননি। ইমতিয়াজকে ১৭ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিল। যেখানে আড়াই ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করার কথা ছিল সেখানে মাত্র আধাঘণ্টার মতো ডায়ালাইসিস করতে পেরেছিল। সাত দিনের মাথায় ২৬শে জুলাই ইমতিয়াজ মারা যায়। ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি ঝিকরগাছায় দাফন করা হয়।
নওশের আলী বলেন, আমার দুই সন্তানের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিল বড়। ২০১৮ সালে বাগ আঁচড়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। জিপিএ-৫ পেয়ে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করে। পরে ইমতিয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকার সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটিতে বিবিএ’তে ভর্তি হয়। আমার একমাত্র মেয়ে তার ভাই মারা যাওয়ার পর একদম ভেঙে পড়েছে। আমেরিকা যেতে না পারলে বিসিএস দেয়ার স্বপ্ন ছিল। সে পাসপোর্টও করেছিল। যেদিন গুলি লেগেছিল সেদিন দুপুর আড়াইটার দিকে তার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছিল। শেষ বাড়িতে এসেছিল কোরবানির ঈদে। ক্লাস শুরু হওয়ায় চার-পাঁচ দিন থেকে ঢাকায় চলে যায়। ১৮ই জুলাই আন্দোলনে যাওয়ার কথা আমাদের বলেনি। শুনে আমি মন খারাপ করি। তখন ইমতিয়াজ বলেছিল, ‘আব্বু আর যাবো না মন খারাপ করিও না।’ ঘটনার দিন শুক্রবারও যখন কথা হয় তার সঙ্গে সারা দেশে নেট বন্ধ থাকায় তাকে আরও সতর্ক করি। সে বনশ্রী-সি ব্লকে হোস্টেলে থাকতো সেখানে কোনোদিনও আমরা যাইনি। আমাদের সঙ্গে না বলে পরেরদিন আবার আন্দোলনে চলে যায়। ওর বন্ধুরা বলেছিল, ইমতিয়াজের যখন গুলি লাগে সে তখন জানতো না। যখন দেখে তার পোশাক ও রাস্তার পিচ রক্তে ভিজে যাচ্ছে তখন সেটি দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। ছেলে যখন আইসিইউতে ছিল তখন বলেছিল-‘বাবা আমি ঠিক আছি তুমি চিন্তা করিও না। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো।’
সন্তানের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই শোক ভোলার মতো না। সন্তানের লাশের ভার বহন করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার বাড়ি পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে। আমার মেয়েটা ভেঙে পড়েছে, ভাইয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিবে। মেয়ে বলে, ‘আমার ভাই নেই, আমারও থাকার দরকার নেই।’ ওর মা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সন্তানের জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমিও বাইরে থাকতে পারি না মনটা ভেঙে গেছে। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। সন্তানের চাহিদা মতো কিছু দিতে পারতাম না তবে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার আশা-ভরসা ছিল এই দুই সন্তানকে নিয়ে। ইমতিয়াজকে ভালোভাবে পড়ানোর জন্য একটি জমিও বিক্রি করেছিলাম। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছুর প্রয়োজন হতো। ক্লাস প্রেজেনন্টেশনের জন্য একটি দামি প্যান্ট বানিয়ে দিয়েছিলাম সেটি সেইভাবে ভাঁজ দেয়া রয়েছে। এখন ঘর জুড়ে শুধু ইমতিয়াজের স্মৃতি। আমরা খুব অসহায় হয়ে গেছি একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে। সে সময় খুব ভয়ে ছিলাম, আমাদের অনেক হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছিল। ইমতিয়াজকে শুক্রবার সকাল নয়টায় দাফন করার কথা ছিল কিন্তু প্রশাসন তখন আমাদের দাফন করতে দেয়নি। ওইদিন রাত সাড়ে এগারোটার দিকে দাফন করা হয়। এখন কে দেখবে আমাদের? কতো স্বপ্ন ছিল ছেলেটাকে নিয়ে।
তিনি বলেন, কোনো কিছুর বিনিময়ে এই শূন্যতা পূরণ করা যায় না। ইমতিয়াজ মারা যাওয়ার পর প্রথমে অনেকে খোঁজ-খবর রাখতো কিন্তু এখন আর রাখে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফোনে তথ্য নিয়েছে কিন্তু এখনো তারা কোনো রেসপন্স দেননি। বাড়িতে এখানের ডিসি সাহেব এসেছিলেন। তখন তার কাছে একটা দাবি করেছিলাম- জে ডি পি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করার জন্য এবং স্কুলটির নাম ‘শহীদ ইমতিয়াজ আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। এটি গ্রামবাসীরও চাওয়া। যশোরে প্রথম শহীদ হয় আমার সন্তান। আরেকজন শহীদ হয়েছিলেন কেশবপুরে। একজন শহীদের বাবা হিসেবে আমাদের এই ছোট্ট দাবিটি সরকারের কাছে। আমার শহীদ সন্তানের স্মৃতিস্বরূপ যেন একটি স্মৃতিফলক হয়।
Ami আমার দাবীও তাই