বাংলারজমিন
নওফেলের ছায়ায় যেভাবে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বাচ্চু
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবারবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামের মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যুবলীগ-ছাত্রলীগের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন। এরমধ্যে ১৬ই আগস্ট মুরাদপুরে গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন দুই কলেজ শিক্ষার্থীসহ তিনজন। সেদিন শিক্ষার্থীদের উপর হামলার সময় একটা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চু। বহদ্দারহাট ও নিউ মার্কেটের ঘটনায়ও সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন বাচ্চুর সশস্ত্র ক্যাডাররা। তবে ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে চলে যান প্রতাপশালী এই বাচ্চু।
আরশেদুল আলম প্রকাশ আরশেদ বাচ্চু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে চেয়েছিলেন মনোনয়ন। তবে দলীয় প্রতীক না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই জমা দিয়েছিলেন মনোনয়নপত্র। আওয়ামী লীগের শক্তিধর নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের অতি আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাচ্চু। মূলত নওফেলের ছত্রছায়ায় নগরের অপরাধ জগতের কিং হয়ে ওঠেন তিনি। এরমধ্যে বাচ্চু বাহিনীর দখল চাঁদাবাজিতে তটস্থ ছিল নগরের জিইসি, ওয়াসা, লালখান বাজার, দুই নম্বর গেইট ও মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দারা। গত ঈদুল ফিতরের আগের রাতে বাচ্চু ও তার সহযোগী কেবি আব্দুল জলিল বাহাদুর নগরের গোলপাহাড় মোড় এলাকার এনএফসি নামের একটি ভবন দখল করে নেয়। শুরুতে এই ভবন মালিককে ব্ল্যাকমেইল করে ভবনটির জন্য একটি বায়নানামা করলেও একপর্যায়ে ওই রাতে সশস্ত্র ক্যাডারদের দিয়ে ভবনটি দখলে নেয়া হয়। এরপর ভবনটিতে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও দখলে নেন বাচ্চু বাহিনী। ভবনটিতে থাকা রেস্টুরেন্ট এনএফসি ও র?্যাবসন কেয়ারের কর্ণধার শরফুল হক এই বিষয়ে গত ১৪ই মার্চ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। তবে বাচ্চুর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুলিশ সে সময় রেস্টুরেন্ট মালিকের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এমএফসি রেস্টুরেন্টের মালিক শরফুল হক বলেন, দখলকৃত ভবনে গত ১৯ বছর ধরে এমএফসি নামক একটি রেস্টুরেন্ট (বর্তমানে র্যাবসন কেয়ার নামে) ব্যবসা করে আসছিলাম। হঠাৎ করে বাচ্চু ও আব্দুল জলিল বাহাদুরের লোকজন এসে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে চলে যেতে হুমকি দেয়। পরবর্তীতে বাচ্চুর লোকজন ভবনের সামনে লোকজন জড়ো করে কলাপসিবল গেট স্থাপন করেন। সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের ভবনে প্রবেশে বাধা দেন। এরপর থেকে আমরা ব্যবসা হারিয়ে ফেলি। এখন ৫ই আগস্টের পর বাচ্চু পালিয়ে গেলেও সে তার অনুসারীদের দিয়ে ভবনটি দখল করে রেখেছে। দখল হওয়া সেই ভবনের রাফসান কেয়ারের কর্মচারী আব্দুল হক জানান, বাচ্চুর ব্যবসায়ী অংশীদার নাজমুল করিম শারুনও এমএফসি ভবন দখলে জড়িত ছিলেন। বাচ্চু বাহিনী স্টাফদের বের করে দিয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাচ্চুর বিরুদ্ধে ২০২১ সালে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছিলেন সোহেল রানা। যিনি এশিয়ান কমপ্লেক্সের নিচতলায় অটো জন-২ নামে একটি মোটর পার্টস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সে সময় বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। সূত্রমতে, চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতা হত্যার অন্যতম কুশীলব বাচ্চু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে চট্টগ্রামের বিলবোর্ড সিন্ডিকেটের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। নগরের গোলপাহাড় এলাকার জলিল ওরফে বাহাদুরের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গেও সখ্য গড়ে বানিয়েছেন দখলদারিত্বের নজিরবিহীন সাম্রাজ্য। ২০২১ সালের ৭ই এপ্রিল ভোরে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন মিমি সুপার মার্কেট সংলগ্ন হিলভিউ আবাসিক এলাকায় নাহার ভবনের ছয়তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ চৌধুরীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদের স্ত্রী ইসরাত জাহান বাদী হয়ে বাচ্চু, নাজমুল করিম শারুন, যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল রাসেলসহ চার আসামির বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছিলেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালের মে মাসে ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ চৌধুরীকে পাঁচলাইশের সৈয়দ সাকিব নাঈম উদ্দীনের এমএম টাওয়ারে বাসায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আরশেদুল আলম বাচ্চুর নেতৃত্বে বাসায় হামলাও চালানো হয়। পরে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার বিজয় বসাকের উপস্থিতিতে মোর্শেদের কাছ থেকে আরও ১২ কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার কথা বলে স্ট্যাম্পে সই নেয়া হয়। ব্যাংকারের মৃত্যুর পর একটি অডিও রেকর্ড ছড়িয়ে পড়েছিল। যেখানে পুলিশ কর্মকর্তা বিজয় বসাক মোর্শেদকে (আত্মহত্যা করা ব্যক্তি) ধরে আনতে বাসায় পুলিশ পাঠানোর হুমকি দিচ্ছিলেন। সেই মামলায়ও নওফেল বাচ্চুদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন, শাহ আমানত বিমানবন্দরকেন্দ্রিক কার্গো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বাচ্চু। আর তার সঙ্গে আছেন সাবেক হুইপপুত্র শারুনসহ একটি সিন্ডিকেট। এই চক্রটি শাহ্ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানেও জড়িত। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরশেদুল আলম বাচ্চুর মোবাইল নম্বরে ফোন দেয়া হলেও এটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরমধ্যে খবর এসেছে গত ১৪ আগস্ট গোপনে যুক্তরাজ্যে পালিয়েছেন বাচ্চু। যদিও ছাত্র জনতাকে হত্যার ঘটনায় এখনও তার বিরুদ্ধে ২টি হত্যা মামলাসহ মোট ৬টি মামলা হয়েছে।