খেলা
আন্দোলনে ক্রিকেটারদের অবস্থান এ যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি
স্পোর্টস রিপোর্টার
৬ আগস্ট ২০২৪, মঙ্গলবারটানা ৩৬ দিন ধরে আন্দোলন চলার পর গতকাল পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। এর আগে গত এক মাসে সব পেশা-শ্রেণির মানুষ নেমে আসে রাস্তায়।
যুগে যুগে অনেক দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গৃহযুদ্ধেরও উদাহরণ আছে। একইসঙ্গে অনেক ক্রিকেটার-ফুটবলারের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ থেমে যাওয়ার ঘটনাও আছে। গত প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশে চলেছে সহিংস আন্দোলন। যেখানে রোববার একদিনেই প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অবস্থান ছিল যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের বলার মতো কোনো সাফল্য নেই। সিনিয়র লেভেলে নারী ক্রিকেট দলের এশিয়া কাপ জয়ই বড় সাফল্য। আর অনূর্ধ্ব’১৯ পর্যায়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ছেলেদের দল। হালের আফগানিস্তানও এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলেছে। আর বাংলাদেশ একমাত্র দল যারা সবক’টি বিশ্বকাপ খেলেও কখনো শেষ চারে উঠতে পারেনি।
দিনের পর দিন সাফল্য ছাড়া কাটালেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে ক্রেজের অভাব নেই। আগের সিরিজে ধবলধোলাই হলেও পরের সিরিজেই গ্যালারি ভরা থাকে সমর্থকে। সাকিব নিষিদ্ধ হলে সমর্থকরা আন্দোলনে নামে, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দল থেকে বাদ পড়লে বিক্ষোভ হয়। ফেসবুকে প্রিয় খেলোয়াড়দের পক্ষ নিয়ে তর্কযুদ্ধের লড়াই হয়।
গত এক মাস ধরে এই ক্রিকেটারদেরই সমর্থকরা আন্দোলন করেছে। কেউ মারা গেছে, কেউ আহত হয়েছে। রাস্তায় যখন তারা আন্দোলন করছে অনেকেই আসে জার্সি পরে, পেছনে সাকিব, মাশরাফিসহ অনেকের নামই লেখা। অথচ এই এক মাসেও সাকিব বা মাশরাফি কেউ একটা স্ট্যাটাস পর্যন্ত দেননি ফেসবুকে। তাদের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, তারা সরকারদলীয় এমপি। কিন্তু সরকারের বিপক্ষে না বলেও স্ট্যাটাস লেখা যায় এটা বোধহয় তারা জানেন না।
স্ট্যাটাস তো দিলেন না বরং পরের দিন সাকিবের স্ত্রী একটি ছবি পোস্ট করেন ইনস্টাগ্রামে। যেখানে দেখা যায় পরিবার নিয়ে হাসিমুখে চিড়িয়াখানা উপভোগ করছেন সাকিব। এটা দেখে সমর্থকরা আরও ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
শুরুতে কোনো ক্রিকেটারই এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। প্রথমে অনূর্ধ্ব’১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য শরিফুল ইসলাম ও তাওহীদ হূদয় ছাত্রদের ওপর সহিংসতা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।
কিন্তু এরপর বাকিরা বিশেষ করে যাদের পঞ্চপাণ্ডব ডাকা হয় সেই দলের সবার সমালোচনা করা হয়। এরমধ্যে মুশফিকুর রহীম করেন অদ্ভুত এক কাণ্ড। বান্দরের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করেন, এতে সমালোচনা আরও বাড়ে। কয়েক মিনিট পর সেটা ডিলেটও করেন তিনি। এরপরের দিন নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর সহিংসতা নিয়ে পোস্ট দেন। এরপর থেকে তিনি মুখে কুলুপ এঁটেই বসে ছিলেন।
তামিম ইকবাল ভাইয়ের অসুস্থতায় ছিলেন থাইল্যান্ডে। সে কথা জানিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন বটে। তবে তাতেও ছিল দায়সারা ভাব। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ পরশু স্ট্যাটাস দিয়েছেন ন্যায়বিচার চেয়ে। এতে সমর্থকদের আরও রোষানলে পড়েন তিনি। এই শেষ সময়ে এসে এত নিরীহ স্ট্যাটাস দেয়ার দায় দেন অনেকে তাকে। অনেকে কমেন্ট বক্সে লেখেন, ক্রিকেট খেলার সময় যেমন জঘন্য ফিনিশিং দেন এটা তেমন হয়েছে।
লিটন কুমার দাস, এনামুল হক বিজয়, সৌম্য সরকার, তানজীদ তামিম, রিশাদ হোসেনরা যেন কিছু দেখেও দেখেননি। কয়েকজন তো এমনভাবে স্ট্যাটাস দিয়েছেন যাতে সরকার অসন্তষ্ট না হয় আবার শিক্ষার্থীরাও তাদের ওপর ক্ষোভ না রাখে। তবে এখন আর অবশ্য সমর্থকরা তাতে ভুলছেন না, কমেন্ট বক্সে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। তবে নুরুল হাসান সোহান কিছুটা সাহস দেখিয়েছেন। তবে সেটা পুরো ক্রিকেট অঙ্গনকে ডিফেন্ড করতে পারবে না।
ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবার নিজ দেশ আইভরিকোস্টে গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার ইতিহাস কমবেশি সবার জানা। ঘটনা ২০০৫ সালের ৮ই অক্টোবর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আইভরিকোস্ট। ড্রেসিংরুমে উল্লাসে মধ্যে দলনেতা দ্রগবা সবাইকে উল্লাস থামাতে বলেন। ডেকে আনা হয় মিডিয়াকে, পুরো আইভরিকোস্ট তখন টিভির সামনে সরাসরি সমপ্রচারে। শান্ত কণ্ঠে দ্রগবা দিলেন যুদ্ধবন্ধের ডাক।
দ্রগবা ভাষণে বলেন, ‘নারী কিংবা পুরুষ, উত্তর কি দক্ষিণ, পূর্ব কি পশ্চিম; সব আজ এক হয়েছে। এবং এটাই প্রমাণ করেছে একাগ্রতা ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদেরকে বিশ্বকাপের জন্য মনোনীত করেছে। আমরা একসঙ্গে বিশ্বকাপ খেলবো। আমরা কথা দিয়েছিলাম আমাদের জয়োল্লাস সবাইকে একত্রিত করবে। আমি হাতজোড় করি, আপনারা দয়া করে আগ্নেয়াস্ত্র নামিয়ে রাখুন। আফ্রিকার একটি দেশ যাতে প্রচুর সম্পদ আছে, তারা যুদ্ধে নামবে না। দয়া করে আপনাদের অস্ত্র রাখুন এবং নির্বাচনের আয়োজন করুন।’
দলনেতা দ্রগবার সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসলেন পুরো দল। দ্রগবার কণ্ঠে তখনো যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান, ‘যুদ্ধ ও শত্রুতা ভুলে অস্ত্র তুলে রাখুন, ভোট হোক। আমরা আনন্দে বাঁচতে চাই তাই স্টপ ফায়ারিং গানস।’
জিম্বাবুয়েতে অ্যান্ডি ফ্লাওয়াররাও ইতিহাস গড়েন। এ ছাড়া পেলের খেলা দেখতেও যুদ্ধ থামানোর ঘটনা আছে। সেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কি করলেন? এমন অবস্থায় নিশ্চুপ থাকলেন শুরুতে পরে দায়সারা স্ট্যাটাস দিলেন। এতে তাদের আসল চেহারা বের হয়ে আসলো। অনেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন এত সমর্থন, ভালোবাসা তারা আদৌ ডিজার্ভ করেন কিনা।
অবশ্য ইতিমধ্যে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শুরু হয়েছেন তারা। সাকিবের নিজ ফ্যান ক্লাবগুলো ফেসবুকে তাকে বয়কটের ঘোষণা দিচ্ছে। এরমধ্যে একটি স্পন্সর প্রতিষ্ঠান সাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার ছবি একে তাতে জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ট্রল তো চলছেই।
অন্য দেশের ক্রিকেটার থেকে অন্য খেলার অ্যাথলেটরাও জাতীয় জরুরি অবস্থায় এগিয়ে আসেন। সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখেন, কারণ সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশের ক্রিকেটাররা যেন ক্রিকেটের বাইরে কিছু ভাবতেও পারেন না। যদিও নিজেদের কাজ ক্রিকেট খেলা সেটাও পারেন ঠিকমতো। এরা শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবেন, নিজেদের নিয়েই থাকেন। তাদের সমর্থন করা সমর্থকদের জন্য কিছু যায় আসে না ক্রিকেটারদের। না হলে এই অবস্থাতেও ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ভাব দেখাতেন না।
সাকিব মানেই শয়তান আর মাশরাফির কথা কি বলবো জনগণের টাকায় বড়লোক হলে যা হয়