দেশ বিদেশ
৫ দিন পর খুললো ব্যাংক টাকা তোলার হিড়িক, ভোগান্তি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৫ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবারসাপ্তাহিক ও সাধারণ ছুটিসহ টানা ৫ দিন বন্ধ থাকার পর অফিস-আদালতের সঙ্গে খুলেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বন্ধের সময়ে মোবাইল ফিন্যান্স কোম্পানি এবং এটিএম বুথেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলেনি। এতে হাতে নগদ টাকায় টান পড়েছে গ্রাহকের। এ কারণে খোলার খবরে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় শাখায় উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোতে সীমিত পরিসরে সেবা দেয়া হয়। বেশির ভাগ ব্যাংকে অর্থ লেনদেন ছাড়া অন্য কোনো কার্যক্রম তেমন হয়নি। ফলে জমা-উত্তোলনের কাউন্টারে কিছু গ্রাহক থাকলেও বাকিগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। অনেক ক্ষেত্রে পে-অর্ডার, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়েন বেশ কিছু গ্রাহক।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার টাকা জমার চেয়ে উত্তোলনই বেশি হচ্ছে। অন্য বিভাগে তেমন কোনো ভিড় ছিল না। রাজধানীর ব্যাংক পাড়া মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন ও ফকিরাপুল এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় টানা পাঁচ দিন সারা দেশে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট (সরকারের নির্বাহী আদেশে তিন দিন বন্ধ ছিল দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান)। এ ছাড়া গত শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার, যা এখনো বহাল আছে। এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে বুধবার সরকারি-বেসরকারি অফিস চার ঘণ্টার জন্য খুলে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে খুলেছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
বুধবার রাজধানীর সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী এবং বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ঘুরে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন করতে দেখা গেছে। ব্যাংকগুলোর শাখার প্রতিটি সেবা কাউন্টারে উপস্থিত বেশির ভাগ গ্রাহকই এসেছেন টাকা উত্তোলন করতে। অনেকে আসেন বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল পরিশোধও করেছেন ব্যাংকে। এরমধ্যে ব্যবসায়ীদের দু-একজন জমা দিতে এসেছেন।
মতিঝিলের সোনালী ব্যাংকের লোকাল শাখায় আসা এক গ্রাহক বলেন, গত কয়েকদিনে নগদ টাকার জন্য বেশ অস্বস্তিতে ছিলাম। এটিএম বুথ থেকেও টাকা তুলতে পারিনি। কয়েকটি বুথ ঘুরে দেখেছি সেখানে টাকা না থাকায় আমার মতো আরও অনেকেই বেশ সমস্যায় পড়েছেন। ব্যাংক খোলার কথা শুনেই চলে এসেছি।
ব্যাংকে বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, নগদ টাকা না থাকায় নানা সংকটে পড়েন তারা। প্রয়োজনীয় কোনো কিছু কিনতে পারেননি।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, তিন কার্যদিবস ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ সময়ে হয়তো অনেক গ্রাহকই তাদের নগদ টাকা কেনাকাটায় শেষ করেছেন। এ কারণে বেশির ভাগ গ্রাহকই টাকা উত্তোলন করছেন।
এ বিষয়ে মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, তিন দিন পর ব্যাংক খুলেছে। লেনদেন যে অনেক বেশি ছিল উপচে পড়া ভিড় তা নয়, স্বাভাবিক দিনের মতোই হয়েছে। এলসি হয়নি এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সেবাগুলোও দেয়া যায়নি। তবে দেশের ভেতরে এনপিএসবি ও বিইএফটিএন সেবা পেয়েছেন গ্রাহকরা।
ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স শাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সোনালী ব্যাংক রেমিট্যান্স গ্রহণ করেছে এবং প্রবাসীদের পরিবার যারা আছেন তাদেরও এর বিপরীতে অর্থও দেয়া হয়েছে।
মতিঝিল রূপালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে গিয়ে দেখা যায়, টাকা জমা ও উত্তোলনের কাউন্টারের সামনে গ্রাহক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য কাউন্টারগুলো প্রায় ফাঁকা।
এক কর্মকর্তা জানায়, গ্রাহকরা শুধুমাত্র টাকা জমা-উত্তোলন করতে পারছেন। এলসি বা অন্য কোনো ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং হচ্ছে না।
রূপালী ব্যাংকে টাকা তুলতে আসা সেকেন্দার বলেন, একটি পে-অর্ডার ছিল ক্লিয়ারিং হয়নি। পাইকারি পণ্য বিক্রি করি গত কয়েকদিন টাকা দিতে পারিনি তাই মাল আটকা আছে। বাধ্য হয়ে টাকা তুললাম। নগদ টাকা দিয়ে পণ্য আনতে হবে। নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতির মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নেট পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলে এলসি হবে কেমন করে? গত সাত দিন আগে তিনটি এলসি দিয়ে রেখেছি একটাও ওপেন হয়নি। আজ সকালে ব্যাংকে কথা বললাম, তারা জানালো চেষ্টা করছে। এখন ৩টা পেরিয়ে গেল কিন্তু এলসি ওপেন হয়নি।
এদিকে আজও (বৃহস্পতিবার) ব্যাংক খোলা থাকবে বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। এর আগে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে জানান, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। আর একইদিনে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সব অফিস খোলা থাকবে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে টানা তিনদিন বন্ধ ছিল দেশের ব্যাংকগুলো। লেনদেনসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। এ সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ডিজিটাল ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা কার্যক্রমও ব্যাহত হয়। যার কারণে আমদানি-রপ্তানিসহ দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। পরে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) কাছে পাঠানো নির্দেশনায় সীমিত পর্যায়ে ব্যাংকিং চালুর বার্তা দেয়। চিঠিতে বলা হয়, বুধবার ব্যাংকের ৫০ শতাংশ শাখা ও বৃহস্পতিবার ৭৫ শতাংশ শাখা খোলা রাখতে হবে। কারফিউ শিথিল থাকার সময়ে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নির্ধারিত শাখায় সীমিত আকারে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করতে হবে। ব্যাংকগুলো তাদের সুবিধামতো শাখা খোলা রাখার উদ্যোগ নেবে।
চেক ক্লিয়ারিংয়ের নতুন সময়সূচি: সাপ্তাহিক ও সাধারণ ছুটিতে ৫ দিন বন্ধ থাকার পর বুধবার সীমিত পরিসরে খুলেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর এই সময় অর্থাৎ বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার ২ দিনের জন্য চেক ক্লিয়ারিং নতুন সময়সূচি অনুযায়ী চলবে। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস), স্বয়ংক্রিয় চেক নিকাশঘর (বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ-বিএসিএইচ বা ব্যাচ) এবং বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন) এ তিন প্ল্যাটফরমের কার্যক্রম নতুন সময়সূচি অনুযায়ী চলবে। এসব সেবার মাধ্যমে এক শাখা থেকে অন্য শাখায় বা অন্য ব্যাংকের গ্রাহককে অর্থ পরিশোধ ও স্বয়ংক্রিয় চেক নিষ্পত্তি করে থাকে। বিএসিএইচের মাধ্যমে হাই ভ্যালু চেক (৫ লাখ টাকার বেশি) এবং রেগুলার ভ্যালু চেক (৫ লাখ টাকার কম) নিকাশ ব্যবস্থা নিষ্পত্তি করা হয়। হাই ভ্যালুর চেক ক্লিয়ারিংয়ের জন্য দুপুর ১২টার মধ্যে পাঠাতে হবে। এগুলো দুপুর পৌনে ২টার মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। আর যেকোনো রেগুলার ভ্যালুর চেক দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে ক্লিয়ারিং হাউজে পাঠাতে হবে। এসব চেক দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। আরটিজিএসের লেনদেন হবে বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফটিএন) সেবা আগের নিয়মে চলবে বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।
ঋণ-ক্রেডিট কার্ডের বিলম্ব ফি পরিশোধে জরিমানা দিতে হবে না: কারফিউ চলাকালে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এ সময়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। যেসব গ্রাহক তাদের ঋণের কিস্তি ও ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারেননি তাদের বাড়তি ফি বা চার্জ দিতে হবে না। কারণ নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় অতিরিক্ত সুদ আরোপ করবে না ব্যাংকগুলো। ব্র্যাক ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, বিদেশি খাতের স্টান্ডার্ড চার্ডার্ড ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের মোবাইলে খুদে বার্তার মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়ে দেয়া হয়েছে।