ঢাকা, ৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

প্রথম পাতা

যেভাবে ‘৪০০’ কোটির মালিক জাহাঙ্গীর

স্টাফ রিপোর্টার
১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
mzamin

জাহাঙ্গীর আলম। বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিলের নাহারখিলে। বাবা রহমত উল্যাহ ইউনিয়ন পরিষদে কেরানি ছিলেন। সংসারে ছিল টানাপড়েন। ঠিকমতো লেখাপড়াও করতে পারেননি। ৯০ দশকে ঢাকা এসে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। থাকতেন ধানমণ্ডির জিগাতলা এলাকায়। সেই সুবাদে মাঝেমধ্যেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুধাসদনের বাড়ির সামনে যাওয়া-আসা করতেন। নিজের এলাকা থেকে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতেন। পরে তিনি সুধাসদনের সামনে আসা দলীয় নেতা-কর্মীদের পানি খাওয়ানোর কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই চাটখিলের মানুষ তাকে ‘পানি জাহাঙ্গীর’- নামে চিনতেন। দলীয় সভানেত্রীর বাড়িতে কাজ করার সুবাদে অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে জাহাঙ্গীরের। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর চাকরি পান। টানা দুই মেয়াদের পুরো সময় এবং তৃতীয় মেয়াদের আংশিক তিনি এ চাকরিতে ছিলেন। পরে তার নানা অপকর্মের তথ্য এলে গত নির্বাচনের আগেই তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। চাকরি হারানোর পরও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর পরিচয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে যান। পরে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাকে নিয়ে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়।

গত রোববার চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি রোধ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে জানান, তার বাসায় কাজ করেছে এমন এক পিয়ন চারশ’ কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। যার কার্ড সিজ করে বের করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নাম উল্লেখ না করলেও তার এই তথ্য প্রকাশের পরই আলোচনা শুরু হয় জাহাঙ্গীরকে নিয়ে। দলীয় নেতাকর্মীরা জাহাঙ্গীরকেই সেই পিয়ন বলে চিহ্নিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেয়ার দিনেই জাহাঙ্গীর ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নানা সূত্র থেকে আসতে থাকে তার অবৈধ সম্পদের নানা তথ্য।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ পাওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি নানা কাজে হস্তক্ষেপ করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন জাহাঙ্গীর। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, বিঘায় বিঘায় জমি, গরুর খামার, মাছের ঘের, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গড়েন একের পর এক। জাহাঙ্গীরের সহায়তায় ভাগ্য বদলেছে তাদের ভাইদেরও। তারাও এখন কোটিপতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাহাঙ্গীর শুধু অবৈধ সম্পদই অর্জন করেননি, বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের পদ-পদবিও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ী আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে আলোচনায় আসেন এই জাহাঙ্গীর। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে শেষমেশ আর ভোট করতে পারেননি। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা ও নোয়াখালীর নিজ এলাকায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অঢেল সম্পদের মালিক। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালীর চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় একটি ৪তলা বাড়ি করেছেন জাহাঙ্গীর। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। মাছের ঘের। গরুর খামার। মাইজদীর হরি নারায়ণপুরে নোয়াখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে আছে ৮তলা বাড়ি। সেখানেই নেতাকর্মীদের নিয়ে আড্ডা দেন। ‘যারিয়াত ভিলা’ নামের সেই বাড়িটি তার স্ত্রীর নামে বলে জানা গেছে। ধানমণ্ডির জিগাতলা কাঁচাবাজারের পাশে জাহাঙ্গীরের একটি ৬তলা বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মিরপুর-২ নম্বর মসজিদ মার্কেটের পাশে চম্পা পারুল স্কুলের জমি দখল করে একটি ১০তলা ভবন তৈরি করেছে জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন একে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। বাড়ি নং-৫, রোড নং-৩, ব্লক-ই, মিরপুর-২। জাহাঙ্গীর আলম একে রিয়েল এস্টেটের ভাইস চেয়ারম্যান। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই কোম্পানির অনেক বিল্ডিং রয়েছে। এছাড়া উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। শুধু নিজ নামে নয়, সম্পদ করেছেন স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজনদের নামেও। 

জাহাঙ্গীরের যতো সম্পদ: নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় জাহাঙ্গীরের রয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দু’টি দোকান, মিরপুরে সাততলা ভবন ও নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়িতে একতলা পাকা বাড়ি রয়েছে। এদিকে জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রীর নামে আটতলা ভবন রয়েছে, হলফনামায় যার দাম দেখানো হয় ৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মিরপুরে দু’টি ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয় ৪৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ২ হাজার ৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৭৬ লাখ টাকা। নির্বাচনী হলফনামায় জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ সাড়ে ৪ একরের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। স্ত্রীর অকৃষিজমি আছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার। হিসাবের বাইরেও তাদের রয়েছে আরও নানা সম্পদ। তার অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার। স্ত্রীর ব্যাংক স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বন্ড ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এ রকম কোম্পানির শেয়ার আছে ৫৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ২৫ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরের নিজস্ব ৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। স্ত্রীর নামে আছে আরও ৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, একটি গাড়ি, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৭৫ তোলা স্বর্ণের দাম দেখানো হয় ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর স্বর্ণ আছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকার। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকার, স্ত্রীর নামে আছে ৯ লাখ টাকার। জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত পিস্তলের দাম ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ টাকার। সব মিলিয়ে কৃষি খাতে তার বছরে আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ১১ লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের আয় ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। চাকরি থেকে ভাতা দেখানো হয় বছরে ৬ লাখ টাকা এবং অন্য উৎস থেকে বছরে আয় আরও ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতের পরেই ব্যাংক হিসাব জব্দ: 
জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে তাদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচদিনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সব ব্যাংকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়েছে।

সুবিধা দিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের: জাহাঙ্গীর আলম রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার পরিবারের একাধিক সদস্যকেও। জাহাঙ্গীর আলমের ভাই দীর্ঘদিন ধরে খিলপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান। তার ভাগিনা মাকসুদুর রহমান শিপন জেলা পরিষদের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান। 

জাহাঙ্গীর এলাকায় এসে চলতেন পুলিশ প্রটোকলে। হেলিকপ্টারেও যেতেন মাঝে মাঝে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে তুলে ধরতেন। আর সাধারণ জনগণ তা বিশ্বাস করতেন। 

২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। এরপর নেতাকর্মীদের কাছ থেকে আলাদা সহানুভূতি পেতেন জাহাঙ্গীর। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীরা ঝুট ব্যবসায় হাত দিলে জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয়ে ফোন করে সরাসরি তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। এই ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি এবং মন্ত্রীদের কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয় দিয়ে তদবির করতেন। চাকরি দেয়ার নামে ও সরকারি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে বিপুল টাকা আয় করেন তিনি। 

অনুসন্ধানে নামছে দুদক: চাকরিচ্যুতির আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়ে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত নভেম্বরেই তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটিতে অভিযোগ জমা দেয়া হয়। দুদক সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ আসার পর সেটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটির গোয়েন্দা ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানে জাহাঙ্গীরের অনিয়মের বিষয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে গোয়েন্দা শাখা তার বিরুদ্ধে গোপন অনুসন্ধান পরিচালনা করে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, গোপন অনুসন্ধানে জাহাঙ্গীর আলমের অঢেল সম্পদের তথ্য মিলেছে। এ বিষয়ে কমিশনে একটি প্রতিবেদনও দেয়া হয়েছে।  

গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধান শেষে জাহাঙ্গীরের অভিযোগনামা চলে যায় দুদকের যাচাই-বাছাই কমিটিতে। সেখানেও যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের ব্যাপারে সম্মতি দেয়া হয়েছে বলে দুদকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, মঙ্গলবার কমিশনের সভা রয়েছে। এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত হবে। বাকিটা কমিশন সভা শেষে বলা যাবে। তবে যতদূর জানতে পেরেছি যাচাই-বাছাই কমিটি অনুসন্ধানের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। 
অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার হোয়াটসঅ্যাপেও সংযোগের চেষ্টা করা হয়। সেখানেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলম যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

 

পাঠকের মতামত

পাখি উড়ে গেছে ।

Kazi
১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার, ২:৩৪ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status