ঢাকা, ৫ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ জিলহজ্জ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি

বাজেটের আগে নতুন খড়গ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১ জুন ২০২৪, শনিবারmzamin

দেশে সাধরণত বাজেট পাসের পর বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তবে এবার প্রতি মাসে সমন্বয়ের নামে আসন্ন বাজেটের আগেই বাড়লো সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। এ নিয়ে টানা তিন মাস জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে বাড়ানো হলো। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কারণে জুন মাসে দাম বাড়ানো হয়েছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করায় এক লাফে প্রতি ডলার ১১০ থেকে সম্প্রতি ১১৭ টাকায় পৌঁছায়। তবে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনাকাটায় এই বাড়তি দাম কতোটা ভূমিকা রেখেছে তা পরিষ্কার নয়। তেলের দাম বাড়ায় ইতিমধ্যেই দেশের কাঁচাবাজারে প্রভাব পড়েছে। বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। 

টানা ২২ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে বাংলাদেশে। পুরো সময় জুড়ে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে।

বিজ্ঞাপন
কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও এ মূল্যস্ফীতিকে এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবাখাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিও এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রভাব ফেলছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এক লিটার জ্বালানি তেলের দাম আড়াই টাকা বাড়িয়েছে সরকার। তার মানে হলো, সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া। অথচ বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও লাভ করছে বিপিসি। তবে কমার সুফল পাচ্ছে না দেশের মানুষ। তাদের বাড়তি দামেই তেল কিনতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম কমালে বাজারে পণ্যের দাম কমতো।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে সরকার গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ঘোষণা করে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া চালুর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলে দেশে কমবে, আবার বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়বে। সরকার চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় ফর্মুলার আলোকে প্রতিমাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করছে। তারই ধারাবাহিকতার প্রাইসিং ফর্মুলার আলোকে ভোক্তা পর্যায়ে এই নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের আগস্টে গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এরপর ২৩ দিনের মাথায় সব জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি তেলে স্বয়ংক্রিয় মূল্যবৃদ্ধির পদ্ধতি ঘোষণা করে সরকার। এরপর গত মার্চ ও এপ্রিলে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানো হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো। এদিন রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ডিজেল ও কেরোসিন ৭৫ পয়সা, পেট্রোল ও অকটেনের দাম আড়াই টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১০৭ টাকা থেকে ৭৫ পয়সা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা ৭৫ পয়সা, পেট্রোলের দাম ১২৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১২৭ টাকা এবং অকটেনের দাম ১২৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা এ দাম শনিবার (১লা জুন) থেকে কার্যকর। 

মূল্য সমন্বয়ের পরেও ভারতের কলকাতায় বর্তমানে ডিজেল লিটার প্রতি ৯০.৭৬ রুপি যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২৫ টাকা ৭০ পয়সা এবং পেট্রোল ১০৩.৯৪ রুপি যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪৩.৯৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ দাম বাংলাদেশ থেকে লিটার প্রতি যথাক্রমে প্রায় ১৭.৯৫ টাকা ও ১৬.৯৬ টাকা বেশি। এর ফলে সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচারের কোনও শঙ্কা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম
অনলাইন পোর্টাল অয়েল প্রাইসের তথ্য অনুযায়ী, গত একমাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের গড় মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৮৮ ডলার থেকে ৮৩ ডলারে নেমেছে। জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের সূত্র নির্ধারণ করে নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি। এতে বলা হয়, অকটেন ও পেট্রোল বিক্রি করে সব সময় মুনাফা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ডিজেল সাধারণত কৃষি সেচে, পরিবহন ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়। অকটেন ও পেট্রোল বিক্রিতে সবসময় বিপিসি লাভ করে। মূলত ডিজেল বিক্রিতেই বিপিসি’র লাভ ও লোকসান নির্ভর করে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশই ডিজেল। বাকি ২৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি। আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। 

৯ বছর ধরে মুনাফা করেছে বিপিসি:
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলে দেড় বছর আগে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। তখন বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমবে। তবে সেটি আর হয়নি। গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া বাড়তি অর্থে দেড় বছর ধরে মুনাফা করছে বিপিসি। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের শুল্ক-কর থেকে বিপুল রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি লভ্যাংশও নিয়েছে সরকার। বিপিসি’র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিপিসি মুনাফা করেছে ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সরকারকে লভ্যাংশ দিয়েছে ২০০ কোটি টাকা। বিপিসি’র সূত্র বলছে, গত অর্থবছরের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ নেয়ার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে বিপিসি’র কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেও (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বিপিসি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোকসানের কথা বলে ২০২২ সালের আগস্টে দেশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড প্রায় ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। তবে ওই অর্থবছরে (২০২২-২৩) নিট ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি। এ নিয়ে গেল ৯ বছরে লাভ করেছে ৪২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। লিটারেই বিপিসি’র মুনাফা হচ্ছে গড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা। বিপিসি শুধু নিজে লাভ করছে তা নয়, সরকারি কোষাগারেও দিচ্ছে বিপুল টাকা। গত ৯ বছরে ১ লাখ ৫৯৭ কোটি টাকা জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

সিপিডি এক গবেষণায় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পর বিপিসি প্রতি লিটার ডিজেলে ৫ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেনে ১৩ টাকা মুনাফা করে। সিপিডি বলেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এই ৭ বছরে বিপিসি মোট ৪৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। কর দেয়ার পর নিট মুনাফা ছিল ৩৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে ৭ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা কর দিয়েছে বিপিসি। 
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status