ঢাকা, ২১ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার

১৫ বছরে ২৬০৪ অভিযোগ, জোড়া লাগে ৫৪৬ সংসার

ফাহিমা আক্তার সুমি
১১ মে ২০২৪, শনিবার
mzamin

পারিবারিক কলহ, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা বিষয়ে নারী ও শিশুদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে উইমেন্স সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। পাশাপাশি ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, এসিড আইন, পর্নোগ্রাফিসহ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলারও তদন্ত করে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ সাল থেকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পারিবারিক সমস্যা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে ভুক্তভোগীরা আসেন। এ সকল ভুক্তভোগীদের তথ্য আগত ভুক্তভোগীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হতো। ২০২২ সাল থেকে পারিবারিক সমস্যা সংক্রান্ত আলাদা ডেস্ক স্থাপন করে ভুক্তভোগীদের আলাদা তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এসেছে ২৬০৪ জন নারী, এরমধ্যে  কোনো মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াই নিষ্পত্তি হয়েছে ২০৫৮ জনের এবং পারিবারিক সুষ্ঠু মীমাংসা হয় ৫৪৬ জনের।  ২০০৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর হতেই সফলভাবে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দান ও সেবা দিয়ে আসছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। ২০১১ সালে এর অধীনে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চালু করে ডিএমপি। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ১০টি সহযোগী এনজিও তাদের কাউন্সেলর, চিকিৎসক, আইনজীবী, মনোচিকিৎসকের মাধ্যমে প্রণোদনামূলক, আইনগত ও পুনর্বাসনের সেবা দিচ্ছে। সহিংসতার শিকার নারীদের বক্তব্য শুনে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়।

বিজ্ঞাপন
এরপর দেয়া হয় সহায়তা। ভুক্তভোগীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেয়া হয়।

 নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং সেবা রয়েছে এখানে। স্বাভাবিক প্রয়োজনে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঁচদিন থাকা যায়। পরিবারের একত্রীকরণ, পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় পাঠানো হয় এখান থেকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। বাংলাদেশের একমাত্র নারী পুলিশ ইউনিট এটি। এর উদ্দেশ্য নারী এবং শিশুদের সমস্যাগুলো নিয়ে খুব ভালোভাবে কাজ করা যায়। নারীরা তাদের সমস্যাগুলো নারীদের কাছে বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শিশুদের ক্ষেত্রেও তাই। ছোট বাচ্চারা নারী পুলিশের কাছে বেশি বলবে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এই ডিভিশনের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।  তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে সেবা পেতে ২ হাজার ২২০ জন নারী-শিশু এসেছে। এরমধ্যে ২০১৯ সালে আগত ৬১২ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪৬ জন, নিজ হেফাজতে ২৩, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ৩৫২ জন, অন্যান্য ৯১ জন, মোট ৬১২ জন। ২০২০ সালে আগত ৫০৭ জন, পরিবারের নিকট হস্তান্তর ২১০ জন, নিজ হেফাজতে ২ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ২১৭ জন, অন্যান্য ৭৮ জন, মোট ৫০৭ জন। ২০২১ সালে আগত ৪৫১ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৫৪ জন, নিজ হেফাজতে ১৫ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ২২২ জন, অন্যান্য ৬০ জন, মোট ৪৫১ জন। ২০২২ সালে আগত ৩৩০ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪০ জন, নিজ হেফাজতে ৩৪ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ১৩৯ জন, অন্যান্য ১৭ জন, মোট ৩৩০ জন। 

২০২৩ সালে আগত ৩২০ জন, পরিবারের কাছে হস্তান্তর ১৪০ জন, নিজ হেফাজতে ৪৩ জন, তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর ১২৯ জন, অন্যান্য ৮ জন, মোট ৩২০ জন। মামলার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট আদেশপ্রাপ্ত মামলা ৩৫২৮টি, কোর্ট পিটিশন ৪৪টি, থানায় সমাপ্ত ২৬৩টি, গৃহীত মামলার সংখ্যা ৩২৬৫টি, নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ৩২৬৩টি, বর্তমানে তদন্তাধীন ২টি, ধর্ষণ ৭৭৪, গণধর্ষণ ৬১টি, অপহরণ ৮১৭টি, শ্লীলতাহানি ৩০২টি, দাহ্য ৩৪টি, যৌতুক ১২২২টি, পাচার ১৭টি, অন্যান্য ৩৮টি, অভিযোগপত্র ২১২৭টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ১১৩৬টি। ২০২০ সালে আদেশপ্রাপ্ত মামলা ২৩৭টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর ১৪টি, গৃহীত মামলার সংখ্যা ২২৩টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ২২৩টি, বর্তমানে তদন্তাধীন শূন্য, ধর্ষণ ৬৭টি, গণধর্ষণ ২টি, অপহরণ ৩১টি, শ্লীলতাহানি ৩৩টি, দাহ্য ১টি, যৌতুক ৭৭টি, পাচার শূন্য, অন্যান্য শূন্য, অভিযোগপত্র ১৬০টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ৬৩টি। ২০২১ সালে আদেশপ্রাপ্ত মামলা ২৯০টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর ১৮টি, গৃহীত মামলার সংখ্যা ২৬৯টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ২৬৯টি, বর্তমানে তদন্তাধীন শূন্য, ধর্ষণ ৯০টি, গণধর্ষণ ৪টি, অপহরণ ৬৫টি, শ্লীলতাহানি ২১টি, দাহ্য শূন্য, যৌতুক ৮৪টি, পাচার শূন্য, অন্যান্য শূন্য, অভিযোগপত্র ২০৩টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ৬৬টি।

 ২০২২ সালে আদেশপ্রাপ্ত মামলা ১৯৬টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর ৯টি, গৃহীত মামলার সংখ্যা ১৭৪টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ১৭৪টি, বর্তমানে তদন্তাধীন শূন্য, ধর্ষণ ৭২টি, গণধর্ষণ ২টি, অপহরণ ৩৭টি, শ্লীলতাহানি ১৩টি, দাহ্য ১টি, যৌতুক ৪৮টি, পাচার শূন্য, অন্যান্য শূন্য, অভিযোগপত্র ১৩৭টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ৩৭টি। ২০২৩ সালে আদেশপ্রাপ্ত মামলা ১৯১টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর ৯টি, গৃহীত মামলার সংখ্যা ১৭৯টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ১৬৬টি, বর্তমানে তদন্তাধীন ১৩টি, ধর্ষণ ৬৫টি, গণধর্ষণ ৩টি, অপহরণ ৩৯টি, শ্লীলতাহানি ২২টি, দাহ্য ১টি, যৌতুক ৪১টি, পাচার শূন্য, অন্যান্য শূন্য, অভিযোগপত্র ১২১টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ৪৫টি। এদিকে ২০২৪ সালের চলতি মাসে আদেশপ্রাপ্ত মামলা ৪৮টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর শূন্য, গৃহীত মামলার সংখ্যা ৪৭টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ১৩টি, বর্তমানে তদন্তাধীন ৩৪টি, ধর্ষণ ২১টি, গণধর্ষণ ১টি, অপহরণ ১২টি, শ্লীলতাহানি ৩টি, দাহ্য শূন্য, যৌতুক ৯টি, পাচার শূন্য, অন্যান্য শূন্য, অভিযোগপত্র ৮টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ৫টি। ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সালের চলতি মাস পর্যন্ত মোট আদেশপ্রাপ্ত মামলা ৪৫২৮টি, থানায় সমাপ্ত ও হস্তান্তর ৩১৩, গৃহীত মামলার সংখ্যা ৪১৫৭টি, নিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা ৪১০৮টি, বর্তমানে তদন্তাধীন ৪৯টি, ধর্ষণ ১০৮৯টি, গণধর্ষণ ৭৩টি, অপহরণ ১০০১টি, শ্লীলতাহানি ৩৯৪টি, দাহ্য ৩৭, যৌতুক ১৪৮২টি, পাচার ১৭, অন্যান্য ৩৮, অভিযোগপত্র ২৭৫৬টি, চূড়ান্ত রিপোর্ট ১৩৫২টি।

 উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ড. হুমায়রা পারভীন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের এই ডিভিশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১১ সালে কিন্তু আমাদের যে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৯ সালে। প্রথমে এটির উদ্দেশ্য ছিল যে ঢাকা শহর এবং তার আশেপাশের এলাকাগুলোতে যে নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয় তাদেরকে আশ্রয় দেয়া। পরবর্তীতে মনে হলো আসলে তাদেরকে শুধুমাত্র শেল্টার বা আশ্রয় দেয়াটাই পুরোপুরি প্রয়োজন মিটছে না, এজন্য তাদেরকে আরও কিছু সেবা দেয়া দরকার। তাদের অভিযোগগুলোও শোনা দরকার যে কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের দমন আইনের মামলাগুলো তদন্তের ক্ষমতা দিয়ে এই ডিভিশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোটামুটি ডিএমপি’র ৫০ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে যে মামলা হয় সেগুলো আমরা তদন্ত করি। এ পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার মামলার তদন্ত হয়েছে।  তিনি বলেন, নারীদের সেবা দিতে পেরে অনেক ভালো লাগে। আমাদের নারীরা অবহেলিত বা বঞ্চিত। বিভিন্ন দিক থেকে কর্মক্ষেত্র, পরিবার সবখানেই। এবং এই বঞ্চনারই একটি ফল সহিংসতা। 

কারণ যখন আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে একটি দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায় তখন কিন্তু সহিংসতার খুব সহজে ভুক্তভোগী হয়ে যায়। যারা এই রকম দুর্বল থাকে তাদের কিন্তু অভিযোগ করার আর কোনো জায়গা থাকে না। বা অনেকে ভয়ে অভিযোগ করতে চায় না। অনেক নারী আছে সে কোনো না কোনো ভাবে সংসারটি টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে বিশেষ করে যারা একটু মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত এরা নির্যাতনের শিকার হলেও কিন্তু মানসম্মানের ভয়ে মামলা করতে উৎসাহী হয় না। বেশির ভাগ অভিযোগ করেন নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে। এই দুই শ্রেণির হারটা বেশি। তবে উচ্চবিত্তরাও আসেন। মামলার মাধ্যমে যে অভিযোগগুলো করা হয় সেটি তো শতভাগ নিষ্পত্তি হয়। আর যারা অভিযোগ করেন তাদের ৭০-৮০ শতাংশই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়। আর বাকি ২০-৩০ শতাংশ সমাধান করা যায় না। তাদেরকে আইনি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। পারিবারিক যে মূল্যবোধ বা শিক্ষা সেক্ষেত্রে আমাদের আরেকটু স্ট্রং হতে হবে। একটা ছেলে বাচ্চা যদি ছোট বেলা থেকেই দেখে যে আমার মা প্রতিনিয়ত বাবার দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে তাহলে সেও কিন্তু এটা একটা সাধারণ বিষয় মনের মধ্যে ধারণ করে নিবে। কারণ সে তো এসব দেখেই বড় হচ্ছে। এবং এই বিষয়গুলো তাদের বড় হলেও প্রভাব ফেলবে। সবার আগে পরিবারের মানুষকে সচেতন হতে হবে।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status