ঢাকা, ১৮ মে ২০২৪, শনিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

ঘটছে দুর্ঘটনা, কোটি কোটি টাকার ক্ষতি, শিডিউল বিপর্যয়

ট্রেনে ছোট ভুলে বড় খেসারত

স্টাফ রিপোর্টার
৫ মে ২০২৪, রবিবার
mzamin

নিরাপদে যাত্রার জন্য মানুষের পছন্দের বাহন ট্র্রেন। এজন্য ট্রেন যাত্রায় চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সেই চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে না ট্রেনের যাত্রী বহনের সক্ষমতা। একইসঙ্গে ট্রেন যাত্রার নিরাপত্তা নিয়েও রয়েছে হেলাফেলা। এতে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। ছোট 
ছোট ভুলের কারণে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। একইসঙ্গে বড় ক্ষতি হচ্ছে সরকারি সম্পত্তির। 

দুর্ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি মেরামতের জন্য মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়তে হচ্ছে রেলকে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে স্বস্তির ট্রেন যাত্রা অস্বস্তিতে পরিণত হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। 
সম্প্রতি গাজীপুরের জয়দেবপুর স্টেশনের আউটার সিগন্যালে নগরের পূর্ব চন্দনা এলাকায় তেলবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে দু’টি ট্রেনের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়।

বিজ্ঞাপন
এ ঘটনায় দুই চালকসহ ৪ জন আহতও হয়েছেন। রেলওয়ে সিগন্যালিং কোনো ত্রুটির কারণে কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে। গত ১৭ই মার্চ কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হাসানপুর রেলস্টেশনের কাছে চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ৯টি কোচ লাইনচ্যুত হয়। গত বছর ২৩শে অক্টোবর কিশোরগঞ্জ ভৈরবে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। আন্তঃনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ও একটি মালবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই ঘটনার কারণ সম্পর্কে কন্টেইনারবাহী ট্রেনটি সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করার বিষয়টি উঠে আসে। এতে চালক সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও উঠে আসে। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে মালবাহী দুই ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনার পর রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, লোকোমাস্টার (চালক) ও স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বহীনতার কারণে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ হয়েছিল।

ছোট ছোট ভুলের কারণে রেলওয়েকে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলী। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মোটিভেট করে যাচ্ছি। তাদেরকে নিয়মিত শেখানো হচ্ছে। তারা আমাদেরই স্টেশন মাস্টার। বাইরে থেকে কোনো লোক নেয়া হয় না। শুক্রবার যে ঘটনা ঘটেছে তার হাত দিয়ে ২০ বছর কমলাপুরের সকল ট্রেন অপারেশন হয়েছে। তাকে আমরা ওখানে চুক্তিতে দিয়েছি। কিন্তু তার সময়ই ভুল হয়ে গেছে। একটি দুর্ঘটনা হলে মেরামতের খরচ, ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়া, অন্য ট্রেনগুলো বিলম্ব হওয়া, যাত্রীরা টাকা ফেরত নেয়। নানা সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১১১৭টি ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৪২২ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ১৩৫০ জন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ২০২২ ও ২০২৩ সালে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে এখন রেলপথ আছে তিন হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে চার হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। সে হিসেবে বাকি রেলপথ পুরনো। পুরনো রেলপথের বড় অংশের রেললাইন বৃটিশ আমলে নির্মাণ করা। বর্তমানে দেশের রেলপথ দুই অঞ্চলে বিভক্ত- পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। দুই অঞ্চল মিলে এক হাজার কিলোমিটার রেললাইন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে। কিছু কিছু রেললাইন আছে যেটি ৩০ বছরেও সংস্কার হয়নি। বেশির ভাগ লাইনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে। আবার কোনোটির শেষ হওয়ার পথে। এ ছাড়া এখনো সিগন্যাল চলছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। আর তাই বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা। রেলে লোকবল সংকটের কারণে ভাড়া করা অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে করানো হচ্ছে অপারেশনাল কাজ। এতেই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। 

জনবল ঘাটতি, পরিকল্পনার অপরিপক্বতা ও রেলের অব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে উল্লেখ করে পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনবল তৈরিতে বিনিয়োগ হয়নি। রেল পরিচালনা দরদ দিয়ে করতে হয়। রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এসব করার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা হয়নি। এতে পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ট্রেনচালক, বা সহকারী ট্রেন চালক, লাইনসম্যান, স্টেশন মাস্টারদের দক্ষ করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কী উদ্যোগ নিয়েছে এটা বড় প্রশ্ন। শুধুমাত্র মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ভুলের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু অনিয়মিত কর্মী, অদক্ষ কর্মী কিংবা চুক্তিতে যারা কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে তারা তো বড় ভুল করছেন। 
তিনি বলেন, ট্রেনে দুর্ঘটনা হলে যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। যদি সিংগেল রেললাইন হয় সেক্ষেত্রে রাজধানীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চল পুরোটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়া যাত্রীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। তাদের ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। স্টেশনগুলোতে যাত্রীসেবা দেয়ার জন্য যে ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন ছিল তারও সংকট আছে। এর ফলে একদিকে ভোগান্তি অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতি আছে। 

এদিকে সম্প্রতি গাজীপুরে দুর্ঘটনার কারণে শনিবার প্রায় সবগুলো ট্রেনেই ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। প্রতিদিন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৫৩টি ট্রেন ছেড়ে গেলেও এদিন বিকাল পর্যন্ত মাত্র ৪টি ট্রেন সঠিক সময়ে ছেড়েছে। বাকি ট্রেনগুলো ২ থেকে ৩ ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে। তবে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও তা দুপুরের মধ্যেও প্ল্যাটফরমে এসে পৌঁছায়নি। 

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল সূত্র জানায়, লাইন ক্লিয়ার না হওয়ার কারণে জয়দেবপুর হয়ে যে ট্রেনগুলো যাতায়াত করে সেগুলোর বিলম্ব হছে। শুক্রবার থেকেই এসব ট্রেন বিলম্বে ছাড়ছে। সিংগেল ট্রেন অপারেশন হলে একই লেন দিয়ে সব ট্রেন যাওয়া-আসা করে; তাই সময় লেগে যায়। রাজশাহী থেকে সিল্কসিটি ছাড়ার কথা সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে। সেটা ছাড়া হয়েছে দুপুর দেড়টায়। পদ্মা এক্সপ্রেস বিকাল ৪টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সেটা রাত ৮টার আগে ছাড়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার সকাল ৬টায় রাজশাহী ধূমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ৮টায়, ৬টা ১৫ মিনিটের কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৮টায়, ৬টা ৪৫ মিনিটের চিলাহাটিগামী চিলাহাটি এক্সপ্রেস ৯টায়, ৭টা ১৫ মিনিটের নীলফামারীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস সাড়ে ৯টায়, চট্টগ্রামগামী ৭টা ৪৫ মিনিটের মহানগর প্রভাতী দশটার দিকে ছেড়ে যায়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার শনিবার বিকালে বলেন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলো বিলম্বে ছাড়ছে। এখনো লাইন পুরোপুরি ঠিক হয়নি। আশা করি রোববার থেকে সব স্বাভাবিক হবে।

পাঠকের মতামত

মেহেরবানী করে ডাবল লাইন করেন। দুর্ঘটনা কম হবে। সিঙ্গেল লাইন একটা ট্রেন বসিয়ে আরেকটাকে যেতে দেয়া, ম্যানুয়াল প্রসেসে দুর্ঘটনা হবেই।

jaki
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ১:২৪ অপরাহ্ন

এগুলি নিছক স্যাবটাজ

Ahmad Zafar
৫ মে ২০২৪, রবিবার, ৬:০৪ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status