ব্লাড স্কিমের আড়ালে রাবি ছাত্রলীগের সিট দখলের অভিনব কৌশল

গত ২৪শে অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলমান সিট বাণিজ্য ও অবৈধভাবে ‘রুম দখল’ করার কবর রচনা ঘোষণা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব। তবে কমিটির কয়েক মাস না যেতেই নানা অভিযোগে জড়িয়ে পড়ছেন বর্তমান কমিটির নেতারা। রাবি ছাত্রলীগ আবারো পুরনো রূপে ফিরছেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। সিট বাণিজ্য না হলেও হলগুলো থেকে হরহামেশাই আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সিট দখলের অভিনব কৌশল হিসেবে ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে’ নিয়মিত চলছে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্ক’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হলগুলোতে নতুন নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে বর্তমান কমিটি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রক্তের গ্রুপ সংগ্রহের নাম করে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিতে প্রতিদিন রুমে রুমে যাচ্ছেন। অভিনব কৌশল হিসেবে ছাত্রলীগ যার নাম দিয়েছে ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিম’। প্রথমে সালাম দিয়ে শিক্ষার্থীদের রুমে প্রবেশ করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রুমে প্রবেশ করেই ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে রক্তের গ্রুপ ও খোঁজখবর নিতে এসেছি’, ‘আমরা ছাত্রলীগ’ এমন পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা। প্রথমে জানতে চাওয়া হয় কক্ষে অবস্থান করা শিক্ষার্থীর রক্তের গ্রুপ।

পরে নাম, সেশন, বিভাগ ও তাদের নম্বর নিয়ে চলে যান তারা। পরে হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীর সেশন অনুযায়ী সময়সীমা শেষ হয়ে আসলে, তার নম্বরে যোগাযোগ করে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
আরও জানা যায়, কিছুদিন আগেই শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে ব্লাড গ্রুপসহ শিক্ষার্থীদের তথ্য নিয়ে আসেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এদিকে বিসিএস পরীক্ষা শেষ না হতেই আবারো ব্লাড গ্রুপ জানতে শিক্ষার্থীদের কক্ষে প্রবেশ করছেন ছাত্রলীগের নেতারা। রুম ওয়ার্কের জন্য মধ্যরাতেও শিক্ষার্থীদের দরজায় কড়া নাড়েন তারা। এ নিয়ে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াতেও দেখা যায়। তথ্য সংগ্রহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। এতে অতিষ্ঠ ১১টি আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কাউকে সিট থেকে নামিয়ে দেয়া ও ওঠানোর পুরো বিষয়ে তদারকি করছে ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবাসিক হলের ইমরান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ব্লাড গ্রুপ সংগ্রহের আড়ালে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্কের’ ফলে প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতে হয়। পড়াশোনা শেষ না হলেও হল সমাপনী হয়ে যাওয়ায় হল ছাড়ার নির্দেশ দেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রথমদিন আমার তথ্য নিয়েছে। এরপর থেকে  টানা তিনদিন আমার রুমে লোক পাঠিয়ে শুনেছে কবে আমি রুম ছাড়বো। এ নিয়ে আমি মানসিক টেনশনে আছি।
ছাত্রলীগের জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে রুম দখলের অভিনব কৌশল নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায় আদনান মাহিম নামের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি তার পোস্টে লিখেন, ‘সরকার খুলেছে সার্বজনীন পেনশন স্কিম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন খুলেছে জয় বাংলা ব্লাড স্কিম। গত এক মাস আগেই তারা হলের রুমে এসে সবার তথ্য এবং ব্লাড গ্রুপ লিখে নিয়ে যায় এবং যথারীতি তার পরের দিন আসে মাস্টার্সের কেউ থাকলে তার কতদূর জানার জন্য। আজ আবার সেই পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বিসিএস পরীক্ষা শেষ মানে আবার রক্তের গ্রুপ দরকার। তাই তারা আবার হাজির সবার ব্লাড গ্রুপ জানার জন্য (হা হা রিয়েক্ট)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, কিছুদিন আগে মধ্যরাতে আমার রুমে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী এসে না বলেই ঢুকে পড়েছে। এসেই জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে এসেছি বলেই আমার সব তথ্য নিয়ে গেলেন। একজন শিক্ষার্থীর রুমে অনুমতি ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী প্রবেশের অনুমতি আছে কিনা হল প্রশাসনের কাছে এমন প্রশ্ন তার?
জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে শিক্ষার্থীদের বিভাগ ও সেশনের তালিকা করে সেই অনুযায়ী তাদের হল থেকে নামিয়ে দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘যদি এরকমটা হয় সেটা আমি দেখবো। তবে আমরা চাই জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে, সেই অনুযায়ী আমি ছাত্রলীগের কর্মীদের নির্দেশনাও প্রদান করেছি।
শুধু আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদেরই কেন তালিকা করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিভাগকেন্দ্রিক করারও আমাদের প্ল্যান আছে। বিভাগ থেকে শুরু করে হলে যত শিক্ষার্থী থাকে সবার তালিকা আমরা করবো। এটা একটি লম্বা প্রক্রিয়া; তবে আমরা শুরু করেছি।’
এ বিষয়ে হল প্রশাসনের পদক্ষেপ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক ড. একরামুল হক বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বা ছাত্র সংগঠনের অধিকার নেই হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ দেয়নি। যেহেতু বিষয়টি আমি শুনেছি এ নিয়ে প্রাধ্যক্ষ পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, ‘হল নিয়ন্ত্রণে রাখার সার্বিক দায়িত্ব হল প্রশাসনের হাতে। জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্কের’ বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি এ বিষয়ে হল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো এবং পরবর্তী  মিটিংয়ে আলোচনা তুলবো।