বাংলারজমিন
ভোলাহাটে জয়িতাদের জীবন জয়
ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি
১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবারনানা প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও জীবন-সংগ্রামে উদ্যমী অনেক নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে সমাজ ও দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যারা কঠিন সংগ্রামে যোগ্যতা অর্জন করে চাকরি ও স্ব-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে নিজেরা হয়েছেন স্বাবলম্বী, এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন অন্যদেরও। কিন্তু জীবন-সংগ্রামে বিজয়ী এদের প্রতিষ্ঠা লাভের দুর্বিষহ গল্প জানে না অনেকেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের নিরক্ষর মা ও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন পিতা-মাতার কোলজুড়ে পৃথিবীতে আসেন আজকের সফল নারী, স্ত্রী, মা ও শিক্ষক উপজেলার ধরমপুর গ্রামের মোসা. রিজিয়া খাতুন। চার ভাই- বোনের মধ্যে তিনি বড়। গ্রামাঞ্চলের নানা বাধা ঠেলে পড়া-শুনা করতে হয়েছে। নিজের পড়া- লেখার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। বাল্যবিয়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়েছে বহুবার। কষ্ট আর সমাজের নানা বাধা অতিক্রম করে আজ তিনি একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ১৯৯৮ সালে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেয়ার পর দু’হাত দিয়ে শুধু কুড়িয়েছেন প্রশংসা আর কর্মদক্ষতার সম্মাননাপত্র ও ক্রেস্ট।
বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ির অবস্থা খুব খারাপ ছিল ঝাউবোনা গ্রামের মো. সাবিরুল ইসলামের স্ত্রী মোসা. ফাইমা বেগমের। বিয়ের পর পর পৃথক করে দেয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। বিপাকে পড়তে হয় সংসার চালানো নিয়ে। স্বামী দিনমজুর, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। সংসারে টানাপড়েন লেগেই থাকে। এ সময় হাল ধরতে হয় ফাইমাকে। চরকার চাকা ঘুরিয়ে শুরু করেন রেশম পোকার গুটির ছাঁট দিয়ে সূতা তৈরীর কাজ। স্বামী-স্ত্রীর বিন্দু বিন্দু আয় দিয়ে দিন চলে যায়। এমন সময় কোলজুড়ে আসে পর পর দুই কন্যাসন্তান। মেয়েরা বড় হয় কিন্তু তাদের পড়ানোর মতো শক্তি ছিল না। এক মেয়েকে ব্র্যাক অপর মেয়েকে প্রশিকা স্কুলে ভর্তি করে পড়া-লেখা করাতে থাকেন। পরে টানাপড়েনের সংসারে পরিশ্রম করে এক মেয়ে ভালো ফলাফল করে আইন বিভাগে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে সহকারী জজ নিয়োগ পায়। অপর মেয়ে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ন করছে। বর্তমানে আমি সংসার জীবনে কঠিন পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মেয়ে দু’জনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বলে জানান মোসা. ফাইমা বেগম। ভোলাহাট উপজেলার পোল্লাডাঙ্গা লম্বাটোলা গ্রামের মো. আশাদুলের স্ত্রী মোসা. মাহমুদা খাতুন ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া-লেখা করে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। দরিদ্র স্বামীর অল্প আয়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। এ সময় আবার এক কন্যা ও পুত্রসন্তানের মা হয়ে যায়। সংসারে আরও ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ে না। বাধ্য হয়ে অভাবের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়েন মাহমুদা। বিভিন্নভাবে অর্থ জোগাড় করে ১০টি গরু ক্রয় করে খামার তৈরি করেন। এ খামার থেকে আয় আসতে থাকলেসংসারের অভাব দূর হতে থাকে।
সেইসঙ্গে এলাকায় বেশ পরিচিতি ঘটতে থাকে। ২০২১ সালে দলদলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি। জনসেবা ও গরুর খামার অব্যাহত আছে তার। তিনি বলেন, এখন বেশ ভালো আছি। জনসেবা আর নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মমর্যাদা বেশ বেড়েছে। উপজেলার কানারহাট গ্রামের মো. মামুন অর রশিদের স্ত্রী মোসাঃ মহরমী খাতুন দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার পরিবারে ৬জন সদস্য থাকায় তিনবেলা খাওয়ার অভাব ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করার মতো সামর্থ্য ছিল না বাবার সংসারে। কষ্টের সংসারে মনের জোরে এসএসসি পাস করেন তিনি। এসএসসি পাসের পর আর পড়া- লেখা ভাগ্যে জুটেনি। এর মধ্যে বাবা মারা যান। একমাত্র কর্মক্ষম বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারে আকাশ ভেঙে পড়ে। শুরু হয় জীবনযুদ্ধের লড়াই। ছোট বাচ্চাদের টিউশনি আর এলাকার লোকজনদের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া। এখান থেকে কিছু আয় হতো। এরি মধ্যে ২০০৩ সালে বিয়ে হয়। স্বামী সংসারে গিয়ে সংসার গোছানোর হাল ধরেন তিনি। এমন সময় কোলে আসে এক পুত্রসন্তান। ছেলেটি পড়ালেখা করছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে এলাকায় বেশ পরিচিতি লাভ করেন মহরমী। ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে ভোটে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সংসার জীবনে কষ্টের পর সচ্ছলভাবে বেঁচে আছি। সেই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেশ সম্মানের সঙ্গে জনগণের পাশে থেকে উন্নয়নমূলক কাজ করছি।