প্রথম পাতা
পর্যালোচনা
পাকিস্তানের নির্বাচন ও একটি বিরল ঘটনা
শহীদুল্লাহ ফরায়জী
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবারগত ৮ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা ভূ-রাজনীতি নিয়ে পর্যালোচনা চলছে কিন্তু রাজনীতির খেলায় ক্ষমতাই যেখানে মুখ্য সেখানে হঠাৎ করে একজন বিবেকের বার্তাবাহক উপস্থিত হয়েছেন ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’ নিয়ে। সেটা নিয়েই সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা।
করাচি শহরের প্রাদেশিক বিধানসভার পিএস-১২৯ আসনে হাফিজ নাঈম উর রেহমানকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নাঈম উর রেহমান বলছেন, এই আসনে মূলত বিজয়ী হয়েছেন তেহরিক-ই-ইনসাফের অর্থাৎ পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফ বারী। হাফিজ নাঈম উর রেহমান আরও বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফ বারী তার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অর্থাৎ ইমরান খানের আসন কমাতে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং এই আসনটি তিনি ছেড়ে দেবেন। এটা সমকালীন ও ঐতিহাসিক ঘটনা, যা আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
উল্লেখ্য, বিজয়ী প্রার্থী বিবেকের তাড়নায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সশ্রদ্ধচিত্তে নিজের বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ক্ষমতার লোভনীয় হাতছানিকে উপেক্ষা করেছেন, গণতন্ত্র ও সত্যের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করেছেন- এটা আজকের বিশ্বে দুর্লভ ও বিরল ঘটনা।
বিজয় প্রত্যাখ্যান করে হাফিজ নাঈম উর রেহমান বলেছেন, ‘কেউ যদি আমাদের অবৈধ উপায়ে জেতাতে চায় আমরা তা মেনে নেবো না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘জনমতকে সম্মান করতে হবে। বিজয়ীকে জিততে দিন, পরাজিতকে হারতে দিন। কেউ যেন অতিরিক্ত সুবিধা না পায়।’ হাফিজ নাঈম উর রেহমান গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি স্বেচ্ছাচারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের মহৎ আদর্শকে উজ্জীবিত করেছেন। নৈতিক শক্তির দুটি প্রধান অঙ্গ হচ্ছে- ১. ন্যায্যতা উপলব্ধির সামর্থ্য এবং ২. শুভ চিন্তার সামর্থ্য। যা আমাদের রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে।
আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্রকেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রকে ক্ষমতা ধরে রাখার এবং অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার বানিয়ে আজ তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে নির্বাচিত করার সংস্কৃতি অর্থাৎ জনগণকে অপাঙতেয় করে কারচুপির আশ্রয়ে কূটকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে, রাষ্ট্রকে যে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, সে বিবেকের তাড়না পাকিস্তান বা বাংলাদেশে খুব বেশি দেখা যায় না। আমাদের নির্বাচনে রাতে ভোট হয়ে যাচ্ছে, ভোটার উপস্থিতি খুব স্বল্পসংখ্যক হলেও ফলাফল ঘোষণায় লক্ষ লক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন, তারা কেউ কোনোদিন প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনটুকুও অনুধাবন করেননি; বরং জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়েও তৃপ্তি বা গৌরববোধ করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা এবং বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা বা স্বার্থসিদ্ধির কৌশল আমাদের রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই যেন মৌলিক স্বাধিকার ভোগ করতে পারে এ ধারণাই আমাদের অনুপস্থিত হয়ে যাচ্ছে। ভোটাধিকারের সার্বজনীন সুযোগ সবাই যেন সমানভাবে পেতে পারে, কেউ যেন সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় বা কারও সুযোগ যেন খর্বিত না হয়, সে মূল্যবোধ ক্রমাগত রাষ্ট্র থেকে অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনহীনতাই নানানভাবে বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র ক্রমাগত বিপরীত দিক থেকে আক্রান্ত হচ্ছে।
দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এইচ এম এরশাদ অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে রিটার্নিং অফিসারের নিকট মনোনয়ন প্রত্যাহারের পত্র লিখেছিলেন। কিন্তু সরকার কোনো কোনো আসনে প্রত্যাহারপত্র গ্রহণ করেছে এবং কোনো কোনো আসনে গ্রহণ করেনি। ফলে নির্বাচনের অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েও সরকারের কূটকৌশলে এরশাদ সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। যিনি বিবেকের তাগিদে, স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে মনোনয়ন প্রত্যাহারের চিঠিতে নিজে স্বাক্ষর করেছেন অর্থাৎ নৈতিকভাবে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি, তবু নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অথচ নৈতিকতার প্রশ্নে কোনো তাড়না অনুভব করেননি বা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি।
আমাদের দেশের সংসদীয় ইতিহাসেও প্রথম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে একাদশ সংসদের বেলায়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচিত হয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেননি, সেটাও সংসদীয় ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
যে রাষ্ট্রে নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না, সে রাষ্ট্র অসহনীয় অন্যায় সমর্থিত রাষ্ট্র হিসেবেই চিহ্নিত হবে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষের এই জগতে হাফিজ নাঈম উর রেহমানকে অভিনন্দন। তিনি প্রমাণ করেছেন, নৈতিকতাই গৌরবের, ক্ষমতা নয়। ‘সাংবিধানিক নৈতিকতার’ অভাবেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে অহরহ ন্যায্যতা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে নীরব থাকা অসম্ভব।
একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিষয়ের আলোচনা শেষ করছি। বীর আলেকজান্ডারকে একজন দার্শনিক বলেছিলেন, ‘রাজা আলেকজান্ডার, প্রতিটি মানুষ শুধু সেইটুকু জমিরই অধিকারী যেটুকুর উপরে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। আপনিও আমাদের মতো একজন মানুষ কিন্তু আপনি সদাই ব্যস্ত এবং অকারণেই আপনার বাসস্থান থেকে বেরিয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে চলছেন। আপনি নিজের কাছে এবং আমাদের কাছে আপদবিশেষ। শিগগিরই আপনার মৃত্যু হবে। তখন সেটুকু মাটিই আপনার নিজস্ব থাকবে যতটুকু আপনাকে কবর দিতে লাগবে।’
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
[email protected]
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হলে সব জায়েজ!!!
গোটা বিশ্বময় বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অত্যন্ত জঘন্যভাবে কলুষিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বর্তমান মহামারীর মধ্যে অকল্পনীয় নীতি-নৈতিকতার এই বিরল ঘটনার নায়ক হলেন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী করাচির সম্মানিত আমির ইঞ্জিনিয়ার হাফেজ নাঈমুর রহমান। কিন্তু খবরটির কোথাও জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের নামোল্লেখ করা হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বের গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সুতিকাগার বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সুর্য সন্তান রা যদি সামান্য তম ও শিক্ষা নিতেন তাহলে জাতি উপকৃত হত। জয় বাংলা।
The ruling corrupt authority of Pakistan should have come and gotten training from the victorious BD Govt on how to rig elections, how to conceal truth, how to conduct dummy election, how to fill ballot in the night before election, how to show election participation by showing dummy voters. Unfortunately the Pakis are not as matured as present BD Govt or I can say still there are some morality still exists in Pak although I hate their past behavior to Bangladeshis.
ধন্যবাদ শ্রদ্ধা ভাজন শহীদুল্লা ফরাজি স্যার কে সুন্দর লেখনীর জন্য, তবে আরো ভালো হতো যদি বলতে পারতেন যে ব্যক্তি টি এই মহত কাজটি করেছেন তিনি হলো পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী করাচির আমীর মুহতারাম ইন্জিনিয়ার নাঈমুর রেহমান সাবেক মিয়র করাচী।
খুব ভাল বিশ্লেষণ
আমরা ক্রমান্বয়ে লাজ-লজ্জা ও নৈতিকতাহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছি!
লেখাটি অনেক চমৎকার এবং বস্তুনিষ্ঠ। হাফিজ নাইম উর রহমান এবং আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। যে যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করেছেন। এ ধারা আরো শাণিত হোক ।
পর্যালোচনা সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু নিখুঁত ও পক্ষপাতমুক্ত নয়। স্বতন্ত্র, পিটিআই ইত্যাকার শব্দ উল্লেখ করলেও সততা ও নৈতিকতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারি হাফিজ নাঈমের দলীয় পরিচয় প্রকাশ না করা লেখকের হীনমন্যতার পরিচায়ক বৈ নয়।
হাফিজ নাঈম উর রেহমানকে স্বশ্রদ্ধ সালাম। এই মানুষিকতার যদি আমাদের দেশের একটিও মানুষ হতো! সত্যিকারের দেশ প্রেমিক হতো রাজনীতিবিদরা, তা হলে গনতন্ত্রের জন্য আমাদের এতো হাহাকার করা লাগতো না। দেশটা এমনিতেই সোনার দেশে পরিনত হতো।
Thanks for nice writing.
Excellent Article. Every politicians should follow Hafiz Naimur Rahman . I salute him and writer of this article
নাঈম রেহমান, পাকিস্তানের একজন জ্বলন্ত নৈতিক নক্ষত্র। তিনি বিশ্ব উদাহরণ ও বটে। তিনি পাকিস্তানের নন,তিনি সার্বজনি। কােরণ, এই রকম পাকিস্তান মার্কা তথাকথিত নির্বাচন বিশ্বে আরো অনেক দেশে হয়েছে। জানিনা, তাদের নিহত বিবেকে সারা ফেলবে কি না। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখককে। অসাধারণ বিশ্লেষণ ধর্মী অনবদ্য লেখাটির জন্য। ধন্যবাদ মানব জমিনকে।