প্রথম পাতা
সড়ক দুর্ঘটনা পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তি
শুভ্র দেব
২২ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবারসড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিসংখ্যান দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতি বছরই বিগত বছরের রেকর্ড ভাঙছে। মৃত্যুর পাশাপাশি আহতের তালিকাও বেড়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর কতো মানুষ নিহত হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের তথ্যর মিল পাওয়া যায় না। এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য ভিন্নতা থাকে। আর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবের সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টের বিস্তর ফারাক। এতে করে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কতো মানুষ নিহত এবং আহত হচ্ছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের কারণে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল রোড সেফটি রিপোর্ট-২০২৩ এ বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ২১ হাজার ৩১৬ জন। পুলিশের রিপোর্টে সেখানে ২ হাজার ৩৭৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন বলে উঠে এসেছে। তার ৩ বছর পর ২০১৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। একই বছর পুলিশের রিপোর্ট বলছে মৃত্যুবরণ করেছেন ২ হাজার ৬৩৫ জন। সর্বশেষ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২০২১ সালে ৩১ হাজার ৫৭৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন বলা হলেও পুলিশের রিপোর্ট বলছে ৫ হাজার ৮৪ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। এখানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে নিহতদের সংখ্যা সরকারি তথ্যের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পরিসংখ্যান সরকারিভাবে আসা দরকার। সরকার চাইলে তথ্য সংগ্রহের অবকাঠামো গড়ে তুলে সারা দেশ থেকে সঠিক চিত্র তুলে আনতে পারবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানকে অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। এ ছাড়া এ বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যও অবাস্তব বলে জানিয়েছেন তিনি। ১৬ই জানুয়ারি রাজধানীর বনানীর বিআরটিএ ভবনের সভাকক্ষে ‘সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ’ বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এদিন তিনি বলেন, সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্ট অতিরঞ্জিত। এতে তাদের প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
গ্লোবাল রোড সেফটি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গ্রান্টস প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাইফুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, রোডক্র্যাশে দেশে কতো লোক মারা যায় সেটি সরকারিভাবে আসা দরকার। কিন্তু সরকারি তথ্যগুলো অনেক অসম্পন্ন। কারণ যেসব সোর্স থেকে তথ্য নেয়া হয় সেই অবকাঠামো কতোটা ভালো সেটার ওপর নির্ভর করবে নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান উঠে আসছে কিনা। দেশে রোডক্র্যাশের পরিসংখ্যান আসার সিস্টেম ভালো নয়। সেখানে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে আর যত লোক নিহত ও আহত হন তার চেয়ে রিপোর্টেট সংখ্যা অনেক কম। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একটা এস্টিমেট সংখ্যা প্রকাশ করে। সরকারি হিসাবের চেয়ে সেটা কয়েকগুণ বেশি। তারা স্বাস্থ্য সেক্টর ও পুলিশের কাছ থেকেও তথ্য নিয়ে করে। পুলিশের কাছ থেকে যেসব তথ্য আসে সেগুলোর ওপর নির্ভর করা যায়। কারণ এসব ঘটনায় মামলা হয়। তবে সেগুলো যদি হাসপাতালের তথ্যের সঙ্গে মিল রেখে করা হতো তাহলে আরও বেশি তথ্য পাওয়া যেতো। অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৩০ দিনের ভেতরে মারা গেলে সেই তথ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে বিবেচিত হবে। আমাদের দেশে সেটা হয় না। নিউজ পেপারের ওপর ভিত্তি করে সঠিক পরিসংখ্যান করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমরা সবসময় বলি এটা একটা ধারণাগত সংখ্যা। সেকেন্ডারি সোর্স থেকে কখনোই সঠিক তথ্য আসবে না। এই বিভ্রান্তির নিরসন সরকারকেই করতে হবে। বিআরটিএ প্রথমবারের মতো একটি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, ৬৪ জেলা থেকে তারা তথ্য নিয়ে রিপোর্ট করেছে। এজন্য তাদের রিপোর্ট সঠিক। কিন্তু আমরা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দেখেছি এক বছরে সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ হাজার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ৯ হাজারের বেশি ও খুলনা মেডিকেলেও একই পরিমাণ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এখানে তিন হাসপাতালেই ৩২ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। অথচ বিআরটিএ বলছে আহত রোগী সাত হাজারের মতো। বিআরটিএ ১ জেলার সঠিক তথ্য তুলে আনতে পারছে না। সেখানে ৬৪ জেলার তথ্য আরও অনেক বেশি। তাই ঘটনার আরও গভীরে যেতে হবে। নানা সীমাবদ্ধতায় আমরা সেটা পারছি না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যকে অতিরঞ্জিত বলছে বিআরটিএ, এ বিষয়ে তিনি বলেন, সংস্থাটি এমন মন্তব্য করার পর আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ভয়াবহতা অনেক গভীরে। কয়েকটি হাসপাতালের যদি এই অবস্থায় হয় তাহলে সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের কি চিত্র হবে? আমি আমার তথ্যকে একটি ধারণা হিসাবে প্রকাশ করেছি। এটা শুধু সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। প্রকৃত কাজ সরকারকে করতে হবে।