ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি চাই

অনিল মো. মোমিন
২৬ জুন ২০২২, রবিবার

দেশে উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে গড়পরতা কথাবার্তা মাঝে মাঝে আলোচনায় আসলেও এ নিয়ে মূলত ঝড় উঠে কিউএস র‌্যাঙ্কিং প্রকাশের পরপরই। বরাবরের মতো এবারের পরিসংখ্যানের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। তবে এই আলোচনা-সমালোচনা অবশ্য গুটিকয়েক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ আর মিডিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির কারও কাছে এসব র‌্যাঙ্কিয়ের খবর পৌঁছায় কিনা সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তো এবারের কিউএস র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের একটিও নেই। দেশের ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাবি ও বুয়েট র‍্যাঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে রয়েছে। তাও টানা পাঁচ বছর ধরে। অন্যদিকে কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ৫০০ এর মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের ৯টি ও পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ১৬০টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যা আনুপাতিক হারে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি।

বিজ্ঞাপন
তবুও কেউ র‌্যাঙ্কিং এ আসতে পারেনি, উন্নতিও করতে পারেনি। এরপরেও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন হচ্ছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত না করে এত বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কেন গড়তে হবে তার উত্তর সংশ্লিষ্টরা ভালো জানেন। তবে সম্প্রতি আমরা গণমাধ্যম থেকে জেনেছি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। ৫০ একর জমির উপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণে সর্বোচ্চ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি লাগবে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং ইউজিসির নেতৃত্বস্থানীয় একজন। ওই ডিপিপি কমানোর জন্য বলা হলেও সংশ্লিষ্টরা কাটছাঁট করে সেটা আবার ১০ হাজার কোটির ঘরেই রেখেছেন। বেশি বেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহের বড় কারণ হয়তো এটি একটি। এত এত বিশ্ববিদ্যালয় অথচ র‌্যাঙ্কিং নেই এই পাজ্ল (চুুঁষব) বোঝার আগে জানতে হবে এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি আসলে কেমন। 
এক কথায় এদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি আসলে কেমন তা স্পট নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে যে মিল নেই তা সুস্পট। একটি বিষয়ের তাত্ত্বিক ধারণার পাশাপাশি প্রায়োগিক দিকটি অধিক লক্ষণীয়। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায়োগিক দিকটি কী তা লক্ষ্য করলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। প্রায়োগিক দিকটি বুঝতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। রুদ্র নামের ছেলেটি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে গতবার। ছেলেটির ক্লাস শুরু হয়নি তখনো। নিজের বিভাগের সিলেবাস বা পড়াশোনা নিয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণাও নেই। এর মধ্যে একদিন এক বড় ভাইয়ের কাছে এসে জানতে চায় বিসিএসের জন্য সে কী কী পড়বে, কোন কোন বই কিনবে। আরেক শিক্ষার্থী রূপন্তী।  ভর্তি পরীক্ষায় শীর্ষে অবস্থান করেও তুলনামূলক একটি সাধারণ বিষয়ে ভর্তি হয়েছে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানিয়েছিল প্রথম বর্ষ থেকেই চাকরির পড়াশোনা শুরু করতে চায়। ভালো বিষয়ে ভর্তি হলে পড়ালেখার চাপে চাকরির পড়া পড়তে পারবে না। অন্যদিকে অভি ঘুরছে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পেছনে। তাদের পেছনে না থাকলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে না। নেতা হবে সে। আর ক্লাস টপার ছাত্র তৌহিদ মনে করে কোর্সের বাইরে সভা-সেমিনার, শিল্প-সাহিত্য পড়া ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে জড়ানো মানে সময়ের অপচয়। ছদ্মনামের এই চরিত্রগুলো বাস্তব এবং এরা সকল ক‌্যাম্পাসে বর্তমান অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করেন। অথচ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে এক প্রকার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এসবের জন্যেই কী? এরা কী জানে বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কী জিনিস!
শিক্ষকরাই ‘বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা’ কতটুকু রাখেন? শিক্ষকতার নৈতিক দায়িত্ব পালনের চেয়ে তারা বেশি যুক্ত থাকেন রাজনীতিতে, নীল-সাদা দলে, শাপলা-কমলা ফোরামে। এরপর নানান মিটিং-সেটিং শেষ করে যান ক্লাসে। এ যেন খণ্ডকালীন কাজ! কেউ কেউ আবার যথাসময়ে ক্লাস না নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের বসিয়েও রাখেন। কখনো কখনো ক্লাস না নিয়ে ছেড়ে দেন। কারও কারও ক্লাসগুলোও  যেন মনমরা। আবার কোনো শিক্ষক শীট দেখে দেখে বাংলা তরজমা করেন। গৎবাঁধা কিছু আলোচনা আর শীট ধরিয়ে দেন। লেকচারের মান দেখেই বুঝা যায় ঐ ক্লাসের জন্য স্টাডি করে আসেননি। কখনো কোনো শিক্ষক রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যেতে বলেন। আবার ভিসিরা ক্যাম্পাসে না এসে অফিস করেন ঢাকায় বসে। আছে ভিসিদের এমন নানান কেলেঙ্কারি। কেউ আবার দিনের ক্লাস নেন শেষ রাতে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসকেরা কখনো ছাত্রকে থাপড়িয়ে সোজা করে দিতে চান। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান পেতে যেতে হবে ‘লাঞ্চের পর।’ এসব ঘটনা কী কোনোটা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে যায়? এক কথায় উত্তর, ‘যায় না।’
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহারলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কতটা তা একথা থেকে স্পট। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কী সে সম্পর্কে সবার একটি তাত্ত্বিক ধারণা থাকা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়।” এর মানে উৎপাদিত বিদ্যা বিতরণই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়। নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করাও এর কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম. ওয়াহিদ বিখ্যাত বৃটিশ ধর্মতাত্ত্বিক কার্ডিন্যাল জন হেনরি নিউম্যানকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন “বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি পরিবেশ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে নর-নারী এক জায়গায় এসে জড়ো হবেন, এক জায়গায় থাকবেন, ‘তাদের মধ্যে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ভাবের দেয়া-নেয়া হবে। এখানে মনের সঙ্গে  মনের দ্বন্দ্বে, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানের সংঘর্ষে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে, পুরনো জ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, হবে পরিমার্জন-পরিবর্ধন ও পরিবর্তন।’ তিনি ঐ লেখায় আরও উল্লেখ করেন, ‘জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ উইলহেলম ভন হামবল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫) ১৮১০ সালে একটি মেমোরেন্ডামে লিখেছিলেন, ১. শিক্ষণ-গবেষণা, ২. শিক্ষার স্বাধীনতা ও ৩. স্বশাসন-এ তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।’ অপরাপর বক্তব্য থেকে বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে উচ্চ শিক্ষা প্রদান করাসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম করা হয়ে় থাকে। আধুনিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এর ধারণাটি বিস্তৃত এবং ব্যাপক। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, কলা, সামাজিক-বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াদি সবই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে। এভাবে সমাজ, অঞ্চল ও দেশের ক্ষুদ্র পরিসর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে বিশ্বকেন্দ্রিক। এই তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে প্রায়োগিক দিক বিবেচনা করলে দেখি আমাদের দেশে যেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্দি হয়ে আছে কোন এক অদৃশ্য জালে। স্পট করে বললে বিশ্ববিদ্যালয় বন্দি হয়ে আছে রাজনীতির ফাঁদে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে বিকশিত হতে প্রধান অন্তরায় রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। বিশ্বজুড়ে খ্যাতিসম্পন্ন এদেশের রাজনীতি (!) ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপরাজনীতির থাবায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষা। তাই আমরা দেখি রাজনীতির ছোবলে প্রাণ দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। এক শিক্ষার্থী হয়ে যায় আরেক শিক্ষার্থীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। পড়াশোনার পরিবর্তে হাতে তুলে নেয় লাঠিসোটা আর অস্ত্র। এসব দেখার বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকদের। কারণ এখানে খুব কমই ভিসি- শিক্ষক  নিয়োগ হয়। এখানে ভিসি-শিক্ষক নিয়োগের ছদ্মবেশে দলীয় কর্মী নিয়োগ হয়। দলীয় মতাদর্শের শিক্ষক-শিক্ষার্থী যাই করুক, বলুক নির্বিকার থাকে আর ভিন্ন মতাদর্শের হলে নির্বিচারে শাস্তি প্রদান করে। উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে যায় এমন কাজে কমই সম্পৃক্ত থাকেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নির্ভর করে ভিসিদের গুণ-মান-দক্ষতার ওপর। কিন্তু রাজনীতিদুষ্ট এবং ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় উপাচার্য নিয়োগ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় তার সৌন্দর্য হারায়। ভিসিরা তখন দলের প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারিতার বৈধতা নিয়ে নেয়। যার ফলে দেখতে পাই কেউ মানবিকতার অজুহাত দিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ দেয়। কোনো ভিসি আবার দিনের ক্লাস নেন গভীর রাতে। কোনো ভিসিকে আবার আন্দোলন করেও ক্যাম্পাসে আনা যায় না। কোনো ভিসি আবার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান নিয়ে না ভেবে চা সমুচা নিয়ে গর্ব করেন। কেউ আবার শিক্ষার্থীদের ফকির মিসকিন বলে দুর্ব্যবহার করে। কোনো ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী জিজ্ঞেস করলে বহিষ্কার করে দেন। আরেক ভিসি পুকুর চুরি করে আবার শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করেন মামলা। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থী সর্বোত আন্দোলনের মাধ্যমেও কোনো ভিসিদের পদত্যাগ করানো যায় না। শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনেও টনক নড়ে না কারও। এমনকি শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি দাওয়ার আন্দোলনে শিক্ষার্থীর প্রতি বিরোধীদলীয় ব্যবহার করা হয়।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যখন এই হাল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সেখানে আরও করুণ। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া এদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক অবস্থা আরও বেহাল। এগুলো যেন উচ্চ শিক্ষা বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে পড়ালেখার নামে দেদারসে চলছে সনদ বিক্রি। অধিকাংশতে নেই গবেষণা, নেই ল্যাবরেটরি। লাইব্রেরি, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাও নেই। আছে শুধু নানান ফাঁদে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা আদায়ের চোখ ধাঁধানো কলাকৌশল। আর এসব অর্থের পুকুর চুরি চলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট আয়ের হিসাব দিলেও ব্যয়ের নির্দিষ্ট কোনো হিসাব দেয় না ইউজিসির কাছে। এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উপাচার্য  শূন্য ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। উপ-উপাচার্য নেই ৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা নিজেদের মতো করেই পরিচালনা করছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়। বোধ করি অর্থ লোপাটের সুযোগ নিশ্চিতে ভিসি, প্রোভিসি নিয়োগ দিয়ে কর্তৃত্ব কমাতে চায় না।
এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো এখানে মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা নেই। নেই বাক স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন কিম জং-উনের ভূমিকায় অবতীর্ণ আর শিক্ষার্থীরা প্রজা। তাই ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেন বাক স্বাধীনতা। ফলে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উপাচার্যকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করলে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেয় এক বিশ্ববিদ্যালয়। ‘বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে’ এমন কিছু ‘সামাজিক মাধ্যমে’ না লেখার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় আরেক বিশ্ববিদ্যালয়। ফেসবুকে মত প্রকাশ করায় এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জন্য নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় আবরাররা। আপত্তিকর স্ট্যাটাসের অভিযোগে শিক্ষক-কর্মকর্তারা-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আছে হস্তক্ষেপ। আর তাই আছে সান্ধ্য আইন। আছে বিবাহিতরা হলে না থাকতে পারার অদ্ভুত নিয়ম।
কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশা, রাজনৈতিক আগ্রাসন, চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে উচ্চ শিক্ষার যে বার্তা দিচ্ছে তার খেসারত আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিস্তৃত পাঠশালা’র চেয়ে বিসিএস ক্যাডার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে বেশি। এই মোহমায়া ধরতে তাই শিক্ষার্থীরা বিকিয়ে দিচ্ছে বাক স্বাধীনতা। ফলে অন্যায় অবিচারে  তারা রা করছে না। মুখে কুলুপ এঁটে সব দেখে যায় আর গুমরে কাঁদে। অন্যদিকে নিজকে সংস্কার বা জ্ঞান অন্বেষণের পরিবর্তে ওরা এখন অমুক তমুকের নামে মিছিল-স্লোগান আর অভিনন্দনের জোয়ার বইতে মশগুল। আর তাই দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খুনি হয়ে যায় গ্রামের স্বপ্নচারী সম্ভাবনাময় তরুণ। হয় ধর্ষণের সেষ্ণুরিয়ান। কাটে মানুষের পায়ের রগ। যতই সময় যায় ততই নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি বা জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। তাই এখন ভালো ছাত্র মানে শীট মুখস্থ করা হাই সিজিপিএধারী, ভালো ছাত্র মানে কে কতগুলো চাকরির বই শেষ করেছে। এরূপ প্রতিযোগিতায় সৃজনশীলতার অভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে না সৃষ্টিশীল ফার্মে। সুযোগ ও দক্ষতার অভাবে তৈরি হচ্ছে না কাক্সিক্ষত মানের উদ্যোক্তা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠছে উচ্চ সনদধারী বেকারদের কর্মস্থল, নতুন বেকার তৈরির কারখানা। আর তাতে হতাশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে এসব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মিছিল। প্রতিদিনই পাই এক এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর। যদি চিন্তার স্বাধীনতা থাকতো, স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারতো, গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকতো তবে হয়তো অন্য রকম হতে পারতো এই দৃশ্য। শিক্ষার্থীদের দায়বদ্ধতার বোধ বাড়তো। সে সবের অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিয়েছে অনুৎপাদনশীল কাজে। আর এতে করে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকছি আমরা।
কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তি হচ্ছে আটটি সূচক। সূচকগুলো হলো একাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত, চাকরির বাজারে সুনাম, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ও কর্মসংস্থান। এসব সূচকের আলোকে চিন্তা করলে দেখি আমাদের দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নেই। একাডেমিক খ্যাতি নির্ধারিত হয় মূলত শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে। আর এ দুটোর কী অবস্থা তা আমরা সবাই জানি। বিশ্বব্যাপী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। অথচ গনমাধ্যমের তথ্য অনুসারে আমাদের সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয়েই এই মানদণ্ড নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মান নেই স্বয়ং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েরও। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫৪।  বেসরকারি ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০।
এদেশে রাজনীতি, স্বজনপ্রীতি বা টাকার বিনিময় প্রভাবে  নিয়োগ যোগ্যতার সর্বনিম্ন শর্তাবলীতে কিংবা শীট মুখস্থ করে উচ্চ সিজিপিএ ধারণকারী শিক্ষার্থীরাই অধিকাংশ শিক্ষক নিয়োগ পায়। এতে এসব শিক্ষকদের একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে কম  অপরদিকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণেও থাকে আলসেমি। অনেকের গবেষণার উদ্দেশ্য থাকে আবার বেতন স্কেল বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। ফলে আমরা দেখতে পাই সেসব গবেষণায় থাকে প্লেগারিজম। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী থাকলেও বাকি অনেক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়তো জানেই না যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী না থাকলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ম্লান হয়। যদি র‍্যাঙ্কিংয়ে না থাকে, না থাকে যদি মানসম্মত শিক্ষা তাহলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আসবেই বা কীভাবে! আর আন্তর্জাতিক শিক্ষকও নেই। আন্তর্জাতিক শিক্ষক নিয়োগের কোন আগ্রহও নেই এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। অন্যদিকে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ এ আমরা দেখতে পাই ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে গবেষণাখাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা বছরজুড়ে দু-চারটি প্রকাশনা ব্যতীত অন্য কোনো গবেষণা করেনি। আবার গবেষণায় খরচ করেও কোনো প্রকাশনা বের করতে পারেনি ইবি, বেরোবি ও রাবিপ্রবি। সোয়া কোটির বেশি ব্যয় করে হাবিপ্রবির প্রকাশনা ছিল ১টি। নোবিপ্রবি, যবিপ্রবি এবং ববি দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। আর কর্মক্ষেত্রের দিকে নজর দিলে দেখা যায় দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি হচ্ছে না। এমনকি চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও নেই। ৫ বছরের একাডেমিক পড়াশুনার ৫ ভাগও চাকরি পরীক্ষায় কাজে আসেনা। শিক্ষার সঙ্গে নেই কর্মক্ষেত্রের মিল।
এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার স্বকীয়তায় বাঁচিয়ে রাখতে সরকার, রাজনীতি ও ইউজিসির সম্মিলিত সদিচ্ছার প্রয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন রাজনীতিমুক্ত জ্ঞানতাপস, গবেষণাপ্রেমী, শিক্ষার্থী বান্ধব এবং নির্লোভী দক্ষ ভিসি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো উপায়ে এটা করতে হবে। সার্চ কমিটির মাধ্যমেও এমন গুণাবলীসম্পন্ন মেধাবী ও যোগ্যদের খুঁজে নিয়োগ দেয়া যায়। এমন ভিসি প্রয়োজন যিনি হবেন ভিশনারি। তিনি মোহে পড়ে পদ আঁকড়ে ধরে রাখবেন না। হবেন আত্মমর্যাদাবান। বছর দুয়েক আগের ঘটনা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বসন্ত উৎসব পালিত হচ্ছিল। সেখানে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণীর পিঠে ও বুকে আঁকা ছিল কিছু অশ্লীল শব্দ। বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে  শুরু হয় প্রবল সমালোচনা। পরে জানা যায় ওই তরুণ-তরুণীদের কেউই ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। তবুও এমন ঘটনার দায় নেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি পরিপন্থি ঘটনার নৈতিক দায় নিয়ে তিনি পরদিনই পদত্যাগ করেন। উপাচার্যের পদত্যাগের কথা গল্পের মতো শুনালেও গল্প না। ঘটনাটি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছিল। ভিসি সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী কোনো আন্দোলন বা সমালোচনার কারণে সরে যাননি। শুধু নৈতিক দায়ত্ববোধের অনুভূতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। উনার মতো ভিসিরাই পারবেন এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি নিশ্চিত করতে। অন্যথায় এভাবে চলতে থাকলে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি চাই’ বাক্যের মর্মার্থ বোঝার মতো শিক্ষার্থীও পাওয়া যাবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

মোবাইল হ্যান্ডসেট/ ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এখন সংকটে

মৌলভীবাজারে জাতীয় পার্টির সম্মেলন সম্পন্ন / ‘আমরা আওয়ামী লীগে নেই, বিএনপিতেও নেই

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status