দেশ বিদেশ
প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের টাকা নিয়ে বিলাসী জীবন
শুভ্র দেব
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার
সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়িতে চলাফেরা। হাতে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ঘড়ি। ৩০ লাখ টাকা খরচ করে বিবাহবার্ষিকী পালন। বাড়ির গ্যারেজের ৩টি গাড়ির মূল্যে অন্তত ৫ কোটি টাকা। দিন-রাত ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক, আড্ডা, পার্টি। লাইফ স্টাইল দেখলে যে কেউ অবাক হবে। রাজকীয় এই জীবনযাপন করছেন অ্যামাজিং ফ্যাশনের মালিক এএলএম জিয়াউল হকের ছেলে এসএম নিশাত বিন জিয়া রুম্মান। শুধু তিনি নন তার বাবা সহ পরিবারের সবার লাইফ স্টাইল প্রায় একই। কিন্তু অ্যামাজিং ফ্যাশনের মতো ছোটখাটো একটি প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে কীভাবে নিশাত বিন জিয়া রুম্মান ও তার পরিবার রাজকীয়ভাবে জীবনযাপন করছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও তাদের এই উত্থানের রহস্য উদ্ঘাটনও হয়েছে।
নিশাত বিন জিয়া বাবার পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার আড়ালে তিনি বিভিন্ন নামে-বেনামে ব্যবসার কথা বলে উচ্চ লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও খেলোয়াড়দের কাছ থেকে টাকা নেন। যাদের কাছ থেকে টাকা নেন তাদেরকে ভুয়া আইটির ব্যবসার কথা বলেন। বিনিয়োগের টাকা নিয়ে তার বিপরীতে তিনি অনেককে চেকও দেন। আবার মৌখিক বিশ্বাসের ওপর অনেকেই কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদেরকে প্রথমদিকে কিছু লভ্যাংশ দিয়েছেন। কিন্তু কয়েকমাস পর সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এভাবে গত ১ বছরে অন্তত ৩০ জনের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। উপায়ন্তর না পেয়ে ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিয়েছেন।
এসব ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন এহসান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারদিন এহসান। তার কাছ থেকেও প্রলোভন দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছেন নিশাত বিন জিয়া রুম্মান। কিন্তু লভ্যাংশ ও মূল টাকা ফেরত না পেয়ে তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন। পাশপাশি তিনি তাকে লিগ্যাল নোটিশও পাঠিয়েছেন। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার বরাবর দেয়া অভিযোগে ফারদিন এহসান উল্লেখ করেছেন, আমি একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। এসএম নিশাত বিন জিয়া রুম্মান নামের পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে তার স্টেসিস এবং এমেজিং ফ্যাশন লি. এ কিছু টাকা বিনিয়োগ করার প্রলোভন দেখান। বিনিয়োগের বিপরীতে তিনি আমাকে কিছু লাভ দেয়া শুরু করেন। আমার প্রথম বিনিয়োগ এবং লাভের কিছু টাকার অংশ বিনিয়োগ করে পুরো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার। এই টাকার বিপরীতে তিনি আমাকে সিটি ব্যাংকের কয়েকটি চেক দিয়েছেন। বিনিয়োগের পর মাসখানেক কিছু লাভ দেয়ার পর তিনি আমাকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেন। যখন আমি আমার আসল টাকা চাই তখন ব্যবসায় লোকসানের কথা বলে আমাকে আসল টাকা দেয়ায় দ্বিমত পোষণ করেন। গত পাঁচ মাস ধরে আমি এবং আমার মতো আরও অনেক ভুক্তভোগী তার কাছে লাগাতার পাওনা টাকা চেয়ে আসছি। তবুও তার থেকে কোনো সম্ভাব্য তারিখ বা তিনি কোনো চুক্তিতে আসেননি। আমার পাশাপাশি আরও অনেক ভুক্তভোগী আছে যারা তার কাছে তাদের পাওনা টাকা চেয়েও কোনো টাকা ফেরত পাননি। পাঁচ মাস ধরে টাকা আটকে থাকার কারণে ব্যবসায়িক, মানসিক এবং পারিবারিক অনেক সমস্যায় ভুক্তভোগী আমি। ইতিমধ্যে আমি আমার আইনজীবী দিয়ে নোটিশ পাঠিয়েছি। কিন্তু নোটিশ পাঠানোর পর তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি।
ভুক্তভোগী ফারদিন এহসান মানবজমিনকে বলেন, প্রথমে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। পরে বাড়তে বাড়তে ২ কোটি টাকার উপরে হয়েছে। ডিবি তাকে যেদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে কখনো সে সফটওয়ার তৈরি, কখন সার্ভের কাজ আবার লোভে পড়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে বলে জানায়। যার কাছে যা বলে টাকা নেয়া যায় সেভাবেই নিয়েছে। ডিবিতে তার সর্বশেষ কথা ছিল, কোর্টের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করবে। তিনি বলেন, কিছু মানুষকে প্রথমদিকে লভ্যাংশ দিয়েছে। এতে করে তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। শেষের দিকে যারা ছিল তাদেরকে তেমন লাভ দেয়নি।
ফারদিন এহসানের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহিদুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। তারা মামলা করলে ডিবি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
আরেক ভুক্তভোগী পোশাক ব্যবসায়ী আবরার আলম বলেন, সে আমাদের সার্কেলের সবার পরিচিত। ২০২২ সালের শুরু থেকে বাসায় দাওয়াত দিতো। যেকোনো ইভেন্টে পার্টি দিতো। আমাদের সবাইকে ডাকতো আমরাও যেতাম। এভাবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অন্যান্য সবার সঙ্গে এভাবেই ঘনিষ্ঠতা হয়। ধীরে ধীরে সে বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসার কথা বলে টাকা নিতে শুরু করে। আমাকে একদিন বলে ৩০ লাখ টাকা দেন এক সপ্তাহ পরে ১ লাখ লাভ সহ ৩১ লাখ টাকা দেবো। আমিও তার কথামতো দিলাম। এভাবে আমি কয়েকবার দিয়েছি। কমিটমেন্ট অনুযায়ী সে আবার টাকা ফেরত দিয়েছে। তারপর দেখলাম তার লাইফ স্টাইলটা আমাদের চেয়ে ভিন্ন। তাদের পারিবারিক পোশাক, ব্যবসা আমাদের চেয়ে অনেক ছোট ছিল। কিন্তু তার লাইফ স্টাইলটা দেখলে সেটি বুঝা যায় না। তারা ইউরোপিয়ান ছাড়া কোনো গাড়ি চড়ে না। জানতে চাইলে আমাকে বলে সে পোশাকের ব্যবসা করে না। তার ব্যবসা হচ্ছে আইটির । তখন আমাকে বিনিয়োগ করার কথা বলে। তখন আমি লভ্যাংশের জন্য একটু একটু করে অনেক টাকা বিনিয়োগ করি। কিছু কিছু লভ্যাংশও আমাকে দিয়েছে। সর্বশেষ কয়েক মাস ধরে কোনো টাকা দেয়নি। কথা ছিল আমার ও আমার স্ত্রীর ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগে অন্তত মাসে ৩০ লাখ টাকার মতো দেবে। লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাই পাচ্ছি না। তাকে এখন খুঁজেই পাওয়া যায় না। তার বাবাও আমাদের ঘুরাচ্ছে। কথার সঙ্গে কাজের মিল নাই। তিনি বলেন, অনেকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়েছে কিন্তু তারা এক টাকা লাভ পায়নি।
মানবজমিনের কাছে আসা এক অভিযোগে দেখা গেছে, নিশাত বিন জিয়া রুম্মান ভুক্তভোগী ইশরাক কারিম নামের একজনের কাছ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ, চামড়া ব্যবসায়ী ফাহিম শফিউলের ৩৮ লাখ, ফারদিন এহসানের ২ কোটি ৫ লাখ, রাকিন আজিজের ৪ কোটি ৫০ লাখ, পোশাক ব্যবসায়ী আবরার আলম ও তার স্ত্রীর ৩ কোটি, ফারিহা গ্রুপের কাওসার হোসেনের ৬ কোটি, আকিব নামের এক ব্যক্তির ৪০ লাখ, আবরার হোসেনের ৬০ লাখ, ফারিহার ৩০ লাখ, আদনানের ৯ লাখ, আলভির ২ কোটি, রাকিনের ৫ লাখ, ক্রিকেটার ইমরুল কায়েসের ৫০ লাখ, শাহদাব আহমেদের ৯০ লাখ, মাহির মান্নানের ৫ লাখ, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ছেলে নভেদুল হকের ১৫ লাখ, শাহীন নামের আরেক জনের ৪০ লাখ, রাইসা আশরাফুনের ২০ লাখ, সারতাজের ৫ লাখ, নিশাতের পরিবারের ৭২ লাখ, সাদের ৪৫ লাখ টাকা সহ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে দুদিন এসএম নিশাত বিন জিয়া রুম্মানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।