দেশ বিদেশ
বিমানে শিশু ওঠা এই প্রথম নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ
মরিয়ম চম্পা
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের ভল্ট থেকে প্রায় সাড়ে ৫৫ কেজি সোনা চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি যাওয়া এ সোনার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সোনা চুরির এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত ২রা সেপ্টেম্বর। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় পরদিন ৩রা সেপ্টেম্বর রোববার। পরে গুদাম কর্মকর্তারা আটকের রসিদ (ডিএম) মোতাবেক দেখতে পান ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আটক ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা চুরি হয়েছে। এ ঘটনায় কাস্টমসের ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার শেষে রিমান্ডে নিয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বিমানবন্দরের ১৪ স্তরের নিরাপত্তা পেরিয়ে পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাস ছাড়াই এক শিশু নির্বিঘ্নে কুয়েত এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটে উঠেছে। এ ঘটনায় হতভম্ব ওই ফ্লাইটের পাইলট, ক্রুসহ সব যাত্রী। পুরো ফ্লাইটটির ৩৩০ আসনে যাত্রী পূর্ণ থাকায় কেবিন ক্রুরা ওই শিশুটিকে কোনো সিট দিতে না পারায় একপর্যায়ে আসন ছাড়া কীভাবে শিশুটি ফ্লাইটে উঠলো এ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। মঙ্গলবার রাত আনুমানিক ৪টা ১০ মিনিটে এ ঘটনাটি ঘটে। বিমানবন্দরের ভেতরের সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারিসহ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়। পুরো বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করে। সেখানে একটি শিশু কীভাবে প্রবেশ করেছে এটা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
সোমবার মধ্যরাতের এ ঘটনা নিয়ে বিমানবন্দর জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পাসপোর্ট-বোর্ডিং পাস ছাড়া একজন শিশু কীভাবে প্লেনে উঠে গেল এ ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এদিকে এ ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। প্রত্যাহার করা হয়েছে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশ, এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক), কুয়েত এয়ারওয়েজ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং (বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স) প্রতিষ্ঠানের ১০ কর্মকর্তাকে। তদন্ত সূত্র জানিয়েছে, শিশুটি গত ৫ দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। গত তিন মাসে চার বার বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায় সে। এর আগেও বিমানে চড়তে ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। এবার কৌশল পাল্টে বিমানবন্দরে ঢুকে শিশুটি। একটি পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে মিশে যায় সে। তাই কেউ ধরতে পারেনি যে ছেলেটি সেখানে একা কিংবা তার কাছে কোনো পাসপোর্ট বা বোর্ডিং পাস নেই। তার সঙ্গে এভসেক ও বিমানবন্দর থানা পুলিশ একাধিকবার কথা বললেও এর চেয়ে বেশি তথ্য পায়নি তারা। এদিকে বিমানবন্দরে কর্মরত প্রত্যেক কর্মী ডিউটি পাস ব্যবহার করে চলাফেরা করেন। আর যাত্রীরা পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস নিয়ে চলাফেরা করেন। এ ছাড়া বিমানবন্দরে ঢুকে ইমিগ্রেশনসহ প্রায় ৮-১০টি ধাপ পেরিয়ে প্লেনে চড়তে হয়। কোনো ধাপেও শিশুটিকে না আটকানোর বিষয়টি নিরাপত্তাহীনতা বলে মন্তব্য করেছেন অনেক যাত্রী।
এর আগে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহন স্থগিত ছিল। এরপর দেশটির পরামর্শে রেডলাইন অ্যাসিউরড সিকিউরিটির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক হিসেবে। চুক্তি অনুসারে দুই বছরে রেডলাইনকে ৭৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেয়া হয়। প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আকাশপথে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০১৯ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম ধাপের নিরাপত্তা পার হয়ে দ্বিতীয় ধাপের আগে অস্ত্র থাকার ঘোষণা দেন। শটগানসহ এক ব্যক্তিকে বিমানবন্দরে আটকের পর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে একই বছরের ১১ই মার্চ ঘোষণা ছাড়াই অস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশের অভিযোগে যশোরের একজন নেতাকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। এত সিসি ক্যামেরা এবং নিরাপত্তার মাঝে অস্ত্র নিয়ে কোনো ব্যক্তি প্রাথমিক নিরাপত্তা স্তর পার হলো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে।
বিমানবন্দরে পরপর এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে বিমানবন্দরকে কতোটা অরক্ষিত এবং ঝুঁকিতে ফেলবে এবং এ বিষয়ে করণীয় কি এসব নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান, কুয়েত এয়ারওয়েজের স্টেশন ম্যানেজার মাসরুরুল ইসলাম চৌধুরী সুমন এবং এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক বোর্ড মেম্বার কাজী ওয়াহিদ- উল আলম মানবজমিনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, বিমানবন্দর অরক্ষিত। কথাটি সঠিক নয়। কাস্টমসের ঘটনাটি সকলেরই নজরে এসেছে। এটা একটি সংস্থার গুটিকয়েক ব্যক্তির সমন্বয়ে ঘটেছে। তারা অসৎভাবে কাজটি করেছেন। এক্ষেত্রে রক্ষক যারা তারাই ভক্ষক হয়েছেন। ইতিমধ্যে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। এই ঘটনা দিয়ে পুরো বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ নেই। বিমানে শিশু প্রবেশের ঘটনাটি নিরাপত্তা ভেদ করে যেতে পারেনি। শিশুটিকে পুরো সিকিউরিটি চেকিং করা হয়েছে। তার শরীর, ব্যাগ চেক করা হয়েছে। শিশুটির বয়স কম এবং সে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্য যাত্রীদের অভিভাবক দেখিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এটা দেখার দায়িত্ব হচ্ছে ইমিগ্রেশন এবং এয়ারলাইন্সের। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে। কিন্তু সিকিউরিটির চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। তবে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। শিশুটি যেসব স্তর পেরিয়ে গেছে তাদের প্রত্যেককেই অপসারণ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বোঝা যাবে। এ ছাড়া সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে শিশুটিকে ইমিগ্রেশন ভালোভাবে দেখেই নি। সবশেষে বলবো এটি আমাদের জন্য বড় একটি শিক্ষা। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এবং দায়ী প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এটা আমাদের সমগ্র দেশের সম্মানের প্রশ্ন জড়িত। এক্ষেত্রে কুয়েত এয়ারওয়েজকেও প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণভাবে দেখার সুযোগ নেই। বিমানবন্দরের মতো স্থানে এটা গ্রহণযোগ্য না। কুয়েত এয়ারওয়েজের স্টেশন ম্যানেজার মাসরুরুল ইসলাম চৌধুরী সুমন বলেন, ঘটনার দিন আমি ডিউটিতে ছিলাম না। তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট এয়ারওয়েজের কারোর দায়িত্বের অবহেলা পেলে প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা পর্যদের সাবেক বোর্ড মেম্বার কাজী ওয়াহিদ- উল আলম মানবজমিনকে বলেন, বিমানবন্দরের কাস্টমস ভল্ট থেকে বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ চুরি। এর পরপরই বিমানে অনেকগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনী ডিঙিয়ে শিশুর বিমানে প্রবেশ। সব মিলিয়ে এগুলো একটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। আগামী মাসে যেখানে আমরা তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি সেখানে এই ধরনের ঘটনা আমাদের জন্য ভুল বার্তা দিবে। তৃতীয় টার্মিনাল এর কারণে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের এখানে এয়ারলাইন্সগুলো আসবে। সেক্ষেত্রে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে। বিশেষ করে আমাদের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এটা ভালো জানবে। বাংলাদেশ এখানো আন্তর্জাতিকভাবে ক্যাটাগরি-২’তে আছে। ক্যাটাগরি-২তে থাকাকালীন বাংলাদেশ থেকে কোনো এয়ারলাইন্স নিউ ইয়র্কে ফ্লাইট করতে পারছে না। আমরা বহুদিন থেকে এটার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। কারণ সিভিল এভিয়েশনের কিছু ত্রুটি রয়েছে। এই দুটি কারণের সঙ্গে কিন্তু এটাও সংযুক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা একটি দেশের সিভিল এভিয়েশনকে ডাউন করে দেয়। আমরা অতীতে দেখেছি সিকিউরিটির কারণে আমাদের এখান থেকে কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, ইউকে। সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে পরে ইউকে থেকে কোনো একটি সংস্থাকে বাংলাদেশে নিযুক্ত করা হয়। তারা এখানে দু’ বছর কাজ করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে। নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠে যায়। এখন পুনরায় সেই ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা যদি সৃষ্টি হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তো বিদেশি এয়ারপোর্ট সংস্থা আমাদের ফ্লাইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এটাকে সিভিল এভিয়েশনের অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। একটি শিশু পাসপোর্ট-বোর্ডিং ছাড়া বিমানে উঠে যেতে পারে এটা সিকিউরিটি সিস্টেমকে ভালো বার্তা দেয় না। কিছু কর্মচারীকে বরখাস্ত করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। শিশুটি ভেতরে ঢুকতে পারলো কীভাবে সেটাই আমার কাছে অবাক লাগে। এটা ভালোভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া দরকার। এর পেছনে কারও যোগসাজশ ছিল কিনা সেটা দেখাও প্রয়োজন। ফ্লাইটে ঘটনাপ্রবাহে আর কোনো সিট খালি না থাকায় শিশুটি যেতে পারেনি। না হলে সে তো বিমানে করে অন্য দেশে পৌঁছে যেত। সেটাতো আরও ভয়াবহ হতো। তিনি বলেন, এটা পাচারের উদ্দেশ্যে কিংবা সাদাসিধাভাবে শিশুটি ভেতরে ঢুকে থাকতে পারে। অথবা আমাদের নিরাপত্তার জায়গাটি কতোটা শক্তিশালী সেটা জাজ (বিচার) করার জন্য ঘটনাটি কারোর মাধ্যমে ঘটে থাকতে পারে। সেটা বিভিন্নভাবেই হতে পারে। কাজেই এটাকে সহজভাবে দেখলে হবে না। কেন সে ভেতরে ঢুকেছে এবং কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা তদন্ত করে বের করা দরকার। অন্য কোনো যোগসাজশ ছিল কিনা সেটা অবশ্যই তদন্ত করে বের করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।