ঢাকা, ১৭ মে ২০২৪, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সম্পদের পাহাড়

স্টাফ রিপোর্টার
১৪ আগস্ট ২০২৩, সোমবার
mzamin

১৬ বছর ধরে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে চক্রটি। ফাঁস হওয়া এসব প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে অনেকেই মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এমবিবিএস শেষ করে তারা এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরি করছেন। চক্রটি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হাজার খানেক শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেছে। হাতিয়ে নিয়েছে শ’ শ’ কোটি টাকা। গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। এসব টাকা দিয়ে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। আবার অনেকেই অবৈধ পন্থায় আয় করা এসব টাকা বিদেশে পাচার করেছে। চক্রের বেশিরভাগ সদস্য মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টারের আড়ালেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের এক তদন্তে এই চক্রটির সন্ধান মিলেছে।

বিজ্ঞাপন
পরে সিআইডি চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ (৫০), ডা. সোহেলী জামান (৪০), ডা. মোহাম্মদ আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), ডা. মো. জোবায়দুর রহমান জনি (৩৮), ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আখতারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি (৪৫) ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যাংক কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, থাইল্যান্ডের মুদ্রা ১৫ হাজার ১০০ বাথ উদ্ধার করা হয়েছে। 

গতকাল দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে সংস্থাটির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০২০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে জসীম উদ্দীন ও মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ছিলেন জসীম। তার খালাতো ভাই সালাম স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান। তারা আদালতে ৬৪ ধারার জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে সবশেষ গ্রেপ্তার ১২ জনের নাম আসে। সবাই পলাতক ছিলেন। 

মিরপুর মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা তদন্ত করে পাওয়া যায় চক্রটির অন্তত ৮০ সদস্য প্রায় ১৬ বছর ধরে হাজার খানেক শিক্ষার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। পরে ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি’র সাইবার টিম। গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতো। 

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৮ জন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে পাস করে ডাক্তারও হয়ে গেছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেয়া বিভিন্ন ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ছাড়াও চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারা দেশে থাকা চক্রের অন্য সদস্যদের নাম রয়েছে। তাদেরকে ধরতে সিআইডি’র অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস করেছে। এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানি লন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়ান। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ২০ বছরে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ডাক্তার ময়েজ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মানি লন্ডারিং দুটি মামলার এজাহারনামীয় আসামি। তিনি চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা ও পরবর্তীতে জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। গ্রেপ্তার ডা. সোহেলী জামান প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। 

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ডা. ময়েজের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। গ্রেপ্তার ডা. মো. আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালান। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রেকটিস করেন। ডা. জেড এম সালেহীন শোভন মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে থ্রি ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে তিনি অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র?্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।

সিআইডি জানায়, ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িত। নামকরা বিভিন্ন চিকিৎসকের সন্তানদেরও তিনি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। ডা. জিল্লুর হাসান রনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। 

২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‍্যাব প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। বর্তমানে ড্যাব এর সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত টিমের একজন চিকিৎসক। ডা. হিমেল তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। ময়মনসিংহের বেসরকারি কমিউনিটি বেইজড মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলে তার শ্বশুরবাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি করান। জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রওশন আলী হিমু (৪৫) জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরনো সহযোগী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

একইভাবে জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যুবদলের কর্মী। জহিরের পুরো পরিবার বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আব্দুল কুদ্দুস সরকার টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্ন ফাঁসের বড় এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন। গ্রেপ্তার আক্তারুজ্জামান তুষার প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে রাবের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status