ঢাকা, ২০ মে ২০২৪, সোমবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

বিশ্বজমিন

রাশিয়ায় শ্বাসরুদ্ধকর শনিবার, যা যা ঘটলো

মানবজমিন ডেস্ক

(১০ মাস আগে) ২৫ জুন ২০২৩, রবিবার, ৩:৫৮ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:৪০ অপরাহ্ন

mzamin

রুশদের মুখোমুখি রুশরা। শনিবার সকালে রাশিয়ার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ওয়াগনার যুদ্ধ ঘোষণা করলো রুশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেই। আর ওয়াগনার বস ইয়েভজেনি প্রিগোজিন রীতিমতো রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিলেন। তার সঙ্গে ছিল কমবেশি ২৫ হাজার ভাড়াটে সেনা। রুশ সরকারই তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু শনিবার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে হঠাৎ রাশিয়ারই একটি সামরিক হেডকোয়ার্টার দখলে নেন প্রিগোজিন। আর এর মধ্য দিয়েই রাশিয়ায় শুরু হয় এক শ্বাসরুদ্ধকর দিনের। 

বহুদিন ধরেই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ ছিল প্রিগোজিনের। তিনি রুশ সরকারের কাছ থেকে আরও ক্ষমতা ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। ইউক্রেনে ধীর গতিতে যুদ্ধ পরিচালনার যে কৌশল রাশিয়া গ্রহণ করেছে তার সবথেকে বড় সমালোচক ছিলেন ওয়াগনার বস। এছাড়া যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে নিরাপদ রেখে ওয়াগনারকে ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে ব্যবহারও তার মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

বিজ্ঞাপন
আর সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে শনিবার। আচমকাই তিনি রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এবং শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। 

শনিবার সকালে ওয়াগনারের সৈন্যরা ইউক্রেনে তাদের ফিল্ড ক্যাম্প ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তোভে প্রবেশ করে। শ্বাসরুদ্ধকর গতিতে তারা আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং মস্কোর উত্তরে আরেকটি শহর ভোরোনেজের সামরিক স্থাপনা দখল করে নেয়। ওয়াগনার যোদ্ধারা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে, মস্কোসহ রাশিয়ার অনেক অঞ্চলে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জারি করা হয়। মস্কোর মেয়র শহরের বাসিন্দাদের বাইরে ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলতে বলেন।
কেউ যে এভাবে রুশ নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে তা রাশিয়াতো বটেই, গোটা বিশ্বকেই অবাক করেছে। ওয়াগনারের বিদ্রোহ ঘোষণার পর গোটা বিশ্বের চোখ ছিল একই দিকে। ওই ঘটনা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এসে তিনি কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি দেন। তার বক্তব্যের সময় তার চোখে-মুখে প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল স্পষ্ট। তিনি ওয়াগনারের এই বিদ্রোহকে ‘পেছন থেকে ছুরি মারা’ বলে বর্ণনা করেন। 

পাঁচ মিনিটের ভাষণে পুতিন রাশিয়ানদের মধ্যে ঐক্যের ডাক দেন। জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজ আমরা যার মুখোমুখি হয়েছি তা নিশ্চিত ভাবেই বড় বিশ্বাসঘাতকতা। যারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তাদেরকে যথাযথ জবাব দেয়া হবে। পুতিন আরও বলেন, রাশিয়া এখন নব্য নাৎসি এবং তাদের পশ্চিমা প্রভুদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে। এমন সময় প্রিগোজিনের এই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে রুশদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।

তবে পুতিনের এই বক্তব্যের পরেও থামেননি ওয়াগনার। দুপুর গড়াতেই তারা মস্কোর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। টেলিগ্রামে দেয়া পোস্টে প্রিগোজিন বলেন, আমাদের ২৫ হাজার সদস্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। সামরিক অভ্যুত্থানের কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রিগোজিন। প্রিগোজিন বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের খবরটি উদ্ভট। তিনি বলেন, এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়। তবে ন্যায়বিচারের জন্য মার্চ। প্রিগোজিন ঘোষণা করেন যে, রোস্তোভ-অন-ডন শহরে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা তার গ্রুপ ওয়াগনার নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন তারা মস্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। 

প্রিগোজিনের মস্কো অভিযানের আশঙ্কায় বেশ কিছু এলাকায় রাস্তায় গর্ত করে রুশ কর্মকর্তারা। কিছু স্থানে কৃত্রিম ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এছাড়া মস্কোর আসেপাশে রাশিয়ার ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে দেখা যায়। সময় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেমলিনের মধ্যে কি চলছে তা নিয়েও নানা গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কোনো কোনো গণমাধ্যম দাবি করেন, বিদ্রোহের ভয়ে পুতিন ক্রেমলিন থেকে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন। যদিও পরে জানা যায়, পুতিন ক্রেমলিনেই ছিলেন।
এদিকে ওয়াগনারের এই বিদ্রোহের খবরের সঙ্গে সঙ্গেই রোস্তভের দিকে সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেন চেচনিয়ার প্রধান রমজান কাদিরভ। ওয়াগনারকে সাবধান করে দিয়ে তিনি বলেন, আমরা মাতৃভূমি এবং তার অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য সবকিছু করব! এই বিদ্রোহকে অবশ্যই চূর্ণ করে দেয়া হবে। এ জন্য যদি কঠিন রাস্তায়ও হাটতে হয়, তাহলেও আমরা প্রস্তুত। 

তবে শেষ পর্যন্ত নিজের বিদ্রোহ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছেন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি জানান, রক্তপাত এড়াতে তিনি পিছু হটবেন। এরপরই রুশ গণমাধ্যমগুলো ওয়াগনার সেনাদের রোস্তভ ছেড়ে ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার খবর প্রকাশ করে। রাত বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জানা যায়, প্রিগোজিনকে থামানোর আসল নায়ক আসলে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো। তিনিই ক্রেমলিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের একটি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেন। 

রোববার ওই চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করে ক্রেমলিন। এতে বলা হয়, প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে যে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল তা সরিয়ে নেবে রাশিয়া। পাশাপাশি ওয়াগনারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে না। কিন্তু যারা বিদ্রোহে প্রিগোজিনকে সমর্থন দিয়েছে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে। আর যারা সমর্থন দেননি তাদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। 

প্রাথমিকভাবে সব ওয়াগনার সেনাকে ইউক্রেনে তাদের ঘাটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রিগোজিন। আর তিনি নিজে রাশিয়া থেকে বেলারুশে নির্বাসনে যাবেন। খুব সম্ভবত তিনি আর রাশিয়াতে ফিরবেন না বলেই চুক্তিতে উল্লেখ ছিল। রুশ গণমাধ্যমগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ওই চুক্তির অংশ হিসেবে ওয়াগনারের স্বাধীনতা আরও কমে যেতে পারে। রাশিয়ার সরকার এখন থেকে সরাসরি ওয়াগনারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে বলেও শোনা যাচ্ছে। 

রোববার সকাল থেকে রাশিয়ায় সব স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সড়কে চলাচলের যেসব বাধানিষেধ ছিল তা তুলে নেয়া হয়েছে। রোস্তভ শহরেও দেখা গেছে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধে পিএমসি ওয়াগনারের ভূমিকা এখন থেকে কেমন হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। ২০১৪ সাল থেকে চলা ডনবাস যুদ্ধে প্রথম থেকেই ছিল ওয়াগনার। তবে গত বছর রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালালে ওয়াগনার আরও বৃহৎ পর্যায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ওয়াগনারে যোগ দেয় ভাড়াটে যোদ্ধারা। ডনবাস অঞ্চলের সোলেদার ও গুরুত্বপূর্ণ বাখমুত শহর দখল করে ওয়াগনার। রুশ বাহিনীর কোনো সহায়তা ছাড়াই তারা ইউক্রেনীয়দের হটিয়ে দেয় বহু গ্রাম ও ছোট শহর থেকে। ওয়াগনারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও রাশিয়ার সাধারণ মানুষদের কাছে বীরের মর্যাদা পেয়েছিল এই বাহিনী। মস্কোসহ প্রধান শহরগুলোতে ওয়াগনার সদস্যদের বড় বড় ছবি ও বিলবোর্ডও চোখে পড়ে। কিন্তু শনিবারের এক বিদ্রোহে রুশদের কাছে ‘হিরো’ থেকে ভিলেনে পরিণত হলেন প্রিগোজিন।

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status