ঢাকা, ১৭ মে ২০২৪, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

ফান্ড ক্রাইসিস, এলজিইডি’র প্রকল্পে স্থবিরতা

স্টাফ রিপোর্টার
১০ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার
mzamin

ডলার সংকট হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি সীমিত করা হয়েছে। ব্যয় কমাতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করছে। ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এলজিইডি’র বেশির ভাগ প্রকল্প বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সবমিলিয়ে ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে

আর্থিক সংকট আর বরাদ্দ কমে যাওয়ায় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উন্নয়ন প্রকল্প থমকে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্মাণসামগ্রীর উচ্চ দাম। সরকারি বিল না পাওয়ায় অনেক ঠিকাদার নতুন কাজে হাত দিতে পারছেন না। নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাওয়ায় নতুন কাজের দরপত্রে অংশ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অনেকে। 

এসব কারণে কোথাও কোথাও প্রকল্পগুলোর কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পরও বিল পাচ্ছেন না অনেক ঠিকাদার। এলজিইডিসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার তথ্য থেকে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন
তবে কোথাও অর্থ সংকট ও বরাদ্দের ঘাটতি হয়নি উল্লেখ করে এলজিইডি জানিয়েছে, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে কিছুটা কাজ ধীরগতির সৃষ্টি হয়েছে। 

এলজিইডি কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে এলজিইডি’র অধীনে শতাধিক প্রকল্প চালু আছে। করোনার পর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া দেশে ডলার সংকট হওয়ায় আমদানি-রপ্তানি সীমিত করা হয়েছে। ব্যয় কমাতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করছে। ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এলজিইডি’র বেশির ভাগ প্রকল্প বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সবমিলিয়ে ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে। কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। 

এলজিইডি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে এলজিইডি’র আড়াইশ’ প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে গ্রামীণ চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৪৯টি প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে এলজিইডি। বাকি ১০১টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এলজিইডি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হাটবাজার, পুকুর খনন, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, উপজেলা কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কাজ করে যাচ্ছে। এলজিইডিতে বর্তমানে এডিবিভুক্ত প্রকল্পের সংখ্যা ১০১টি। এর মধ্যে ৭৯টি প্রকল্প জিওবি’র অর্থায়নে ও ২২টি প্রকল্প বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৪৬ শতাংশ। ইতিমধ্যেই ১৭টি প্রকল্প শেষের দিকে। 

এলজিইডি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এমই শাখা) মো. শাহ আলমগীর বলেন, বর্তমানে ১০১টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে আরও ১৩টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ১১৪টি প্রকল্প চালু আছে। ১০১টি প্রকল্পে বরাদ্দ হলো- ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬২.৯৭ কোটি টাকা। কাজের অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পে ফান্ডিংয়ে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু ব্যয় কমাতে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে অর্থ সরবরাহ কম হচ্ছে। এর আগেও একবার সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। সরকার পরে তা দিয়ে দিয়েছে। চলমান সংকট কেটে গেলে সরকার আগের মতো অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে বলে আশা করেন তিনি। 

খুলনা থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ অর্থ সংকটের কারণে থমকে দাঁড়িয়েছে। কাজ করেও প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিল পাননি ঠিকাদাররা। এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অর্থ সংকটে বন্ধের উপক্রম। এই প্রকল্পে কাজ করেও বিল পাননি অধিকাংশ ঠিকাদার। প্রায় ২৫ কোটি টাকার বিল বকেয়া রয়েছে এলজিইডি কর্তৃপক্ষের কাছে। একইভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প কেবিএস’র কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। এই প্রকল্পে কাজ করেও ৩৫ কোটি টাকা বিল পাননি ঠিকাদাররা। এ প্রসঙ্গে এলজিইডি’র ঠিকাদার টুটুল অ্যান্ড কোং-এর স্বত্বাধিকারী খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার কারণে ঠিকাদাররা চরম দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে। কোটি কোটি টাকার কাজ করেও বিল না পেয়ে সমস্যায় পড়েছেন তারা। তিনি বলেন, দরপত্রে ইটের মূল্য ছিল ৮ হাজার টাকা, যা বর্তমানে বাজারমূল্য ১৩ হাজার টাকা, রড কেজি ছিল ৫৮ টাকা, যা এখন ১০০ টাকা, সিমেন্ট প্রতি ব্যাগ ছিল ৪০০ টাকা, যা এখন ৫৫০ টাকা, পাথর প্রতি বর্গফুট ছিল ১২০ টাকা, যা এখন ১৮০ টাকা, বালু প্রতি বর্গফুট ছিল ৩৫ টাকা, যা এখন ৫৮ টাকা। একইভাবে চুক্তিপত্রে উল্লিখিত মূল্যের চেয়ে বর্তমানে বাজার মূল্য ৪০ শতাংশ বেশি। এ কারণে ঠিকাদারেরা কোনো টেন্ডার কাজে অংশগ্রহণ করছেন না। 

এ ছাড়া পূর্ণ টেন্ডারেও ঠিকাদার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি বেশ কিছু প্রকল্পে ফান্ড না থাকার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ অর্থ সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এই প্রকল্পের ঠিকাদারদের প্রায় ১০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। একইভাবে কেবিএস প্রকল্পের ২৫ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার কারণে এই দুটি প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ। তবে কিছু কাজ এখন চলমান রয়েছে। ফান্ডের সমস্যা সমাধান হলে আবার সবকিছু সচল হবে।

স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (৩য় পর্যায়) টাকা পরিশোধ না হওয়ায় কুমিল্লার ঠিকাদাররা কষ্টে দিন পার করছেন। কাজ সম্পন্ন করেও তারা বিল পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। এসব কাজের মধ্যে আছে- ব্রিজ ও রাস্তা সংস্কার-উন্নয়ন। এলজিইডি কুমিল্লা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ কার্যালয়ের অধীন এলাকায় ৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার ব্রিজ-কালভার্ট ও সড়ক উন্নয়ন কাজ শেষ হলেও দীর্ঘদিন যাবৎ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা বিল পাচ্ছেন না। একাধিক ঠিকাদার জানান, তারা ধারদেনা করে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কাজ সম্পন্ন করে এখন পাওনাদারদের চাপে আছেন। এ ছাড়া অর্থ সংকটে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় লোকলজ্জার ভয়ে তাদের কষ্টের কথাও কাউকে বলতে পারছেন না। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নানা সমস্যায় পড়ে অনেক ঠিকাদার তাদের কাজ বন্ধ রেখেছেন। 

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, এলজিইডি’র আওতাধীন পঞ্চগড় জেলায় নির্মাণাধীন উন্নয়নমূলক কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কাজের তুলনায় নগণ্য বরাদ্দ ও নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, এমপিদের সুপারিশকৃত অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৭টি প্যাকেজের মধ্যে ৭টি রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে। ১৩টি চলমান থাকলেও কাজের গতি নেই। বাকিগুলো দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়াধীন। আরসিআই প্রকল্পের আওতায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৪.২১ কিলোমিটার ৫টি রাস্তার কাজের মধ্যে ২৭ কি.মি. হয়েছে। বাকিটা চলমান। গ্রামীণ অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২টি রাস্তা ও কালভার্টের মধ্যে উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে ৭০টির। সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটি রাস্তার কাজ হয়েছে ৭০ শতাংশ। ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সেতুর কাজ চলমান। ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারমূলক ৫০টি সড়কের কাজের মধ্যে ১৩টি সম্পন্ন। বাকি চলমান। এফডিডিআরআই প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি সড়কের মধ্যে ২টি সম্পন্ন। একটি চলমান। ৪ কোটি ৯১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ব্যয়ে হাটবাজার উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যে ২টি শেষের পথে। একটি চলমান। ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে কৃষি সম্প্রসারণ উপ- পরিচালকের কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। 

রাওজুল কারিম নামের এক ঠিকাদার বলেন, আমরা কাজ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছি। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য কাজ করতে পারছি না। বিলও পাওয়া যাচ্ছে না। এক ড্রাম বিটুমিনের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ৯৭০০ টাকা। অথচ বাজারে এ সমপরিমাণ বিটুমিনের মূল্য ১৬ হাজার টাকা। প্রতি হাজার ইটের মূল্য ধরা হয়েছে ৯৫০০ টাকা। কিন্তু আমাদের কিনতে হচ্ছে ১৪ হাজার টাকায়। সিমেন্ট ধরা হয়েছে ৪০০ টাকা। কিন্তু কিনতে হচ্ছে ৬০০ টাকায়। শ্রমিক, রড ও তারসহ সব কিছুরই দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এতে নতুন কাজ নেয়ার ব্যাপারে ঠিকাদারদের আগ্রহ কমে গেছে। পঞ্চগড় এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামছুজ্জামান বলেন, টাকার সমস্যা নেই। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তবে আমরা কাজ করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status