ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

কি নেই পি কে হালদারের সাম্রাজ্যে

অশোকনগরের রহস্য পুরুষ

জয়ন্ত চক্রবর্তী, অশোকনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে
১৬ মে ২০২২, সোমবার
mzamin

গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছিল কলকাতা থেকে দূরত্ব সাড়ে ৫৭ কিলোমিটার। সড়কপথে ভ্রমণের সময় এক ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। কিন্তু যশোর রোড দিয়ে হাবড়ার অশোকনগরে পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগে গেল। সকালের ঝিরঝিরে হাওয়ায় সফর মন্দ কাটলো না। কিন্তু যে কারণে কলকাতা থেকে ঠেঙ্গিয়ে অশোকনগর আসা সেই বাংলাদেশের কুখ্যাত কিংবা সুখ্যাত ব্যাংক ফ্রড পি কে হালদার ওরফে প্রশান্ত কুমার হালদারের সম্পত্তির সুলুকসন্ধান পাবো কীভাবে? শিবশঙ্কর হালদার ছদ্মনাম, পরিচয়ে দিব্যি রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড আর প্যান কার্ড নিয়ে তো তিনি বেশ জেঁকে বসেছিলেন অশোকনগরে। এখন অবশ্য ইডি’র হেফাজতে কলকাতায়। গত শনিবার ইডি গ্রেপ্তার করেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার আসামি পি কে হালদারকে এই অশোকনগর থেকে কিংবা কলকাতা থেকে। বাংলাদেশের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি কে হালদার ২২টি ভুয়া কোম্পানি গড়েছিলেন। ব্যাংক এবং অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বিশাল জালিয়াতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির তিনশ’ কোটি টাকা জালিয়াতির মামলায় ভারতের ইডি তাকে গ্রেপ্তার করে।

বিজ্ঞাপন
ভারতেও ভাই প্রীতিশ হালদারকে সঙ্গে নিয়ে ভুয়া কোম্পানি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রশান্ত ওরফে পি কে ছাড়াও ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সুকুমার মৃধা, তার মেয়ে অনিন্দিতা, দুই ভাগ্নে স্বপন ও তপন মৈত্র এবং মৃধার জামাইও। এই সুকুমার মৃধাই নাটের গুরু। পি কে হালদারের টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো, সম্পত্তি দেখাশোনা, মাছের বেড়ির ব্যবসা সব দেখতেন এই সুকুমার মৃধা এবং তার মেয়ে জামাই, ভাগ্নেরা। কান টানলে মাথা আসার মতো মৃধা পরিবারকে জেরা এবং গ্রেপ্তারের পরই পি কে হালদারের হদিস মেলে। অশোকনগরের ১৫ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন বিল্ডিং মোড়। এখানে প্রাসাদোপম বাংলো দেখলে চোখ কপালে ওঠে। অশোকনগরে এইরকম চার চারটি বাংলো। বিঘার পর বিঘা জমি, মাছের বেড়ি। এসবই পি কে হালদারের। খাতা-কলমে বাংলাদেশে তার আইনজীবী, অশোকনগরে মাছ ব্যবসায়ী সুকুমার মৃধার নামে এই সম্পত্তি। আড়ালে রহস্যের মেঘনাদ এই পি কে হালদার। বিল্ডিং মোড়ের কাছে একটি কচুরির দোকানে কচুরি ভাজতে ভাজতে পঞ্চানন ঘোষ বললেন, বড় বড় গাড়ি ঢুকতো বাংলোয়। ভাবিনি এত বড় প্রতারক লুকিয়ে আছে এখানে। বস্তুত, অশোকনগরে এলে কারও সঙ্গেই মেলামেশা করতেন না পি কে হালদার। আসতেন সুকুমার মৃধা কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড একজন ক্রিমিনাল যে এখানে বাসা বেঁধেছেন তা বোঝেননি অশোকনগরের মানুষ। অশোকনগরে দেদারছে সম্পত্তি করা ছাড়াও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়, রাজারহাট নিউ টাউনে, দিল্লি, মুম্বইতে প্রচুর বেআইনি সম্পত্তি করেছেন এই পি কে হালদার। সারদার সুদীপ্ত সেন কিংবা রোজ ভ্যালির গৌতম কুণ্ডু লজ্জা পাবেন পি কে হালদারকে দেখে। বাংলাদেশে প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পর কিছুদিন কানাডায় আত্মগোপন করেন। তারপর পাসপোর্ট জাল করেন কবলার মারফত। ভারতে কীভাবে তিনি আধার,  ভোটার আর প্যান পেলেন সেটাই রহস্যের। অশোকনগরে চাঁদা বিলোতেন সুকুমার মৃধার মারফত দেদারছে। অশোকনগরের সংহতি পার্ক বা মিলিনিয়াম সায়েন্স পার্কে কোনো অনুষ্ঠান হলে পি কে হালদার-এর বকলমে সুকুমার মৃধা হয়ে যেতেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। অশোকনগরে বাংলাদেশের বিশেষ করে বরিশালের  মানুষজন বেশি, তাই কি পি কে হালদার এখানেই ঝাঁকে মিশে যেতে চেয়েছিলেন? ইডি’র জেরায় নিশ্চয়ই উঠে আসবে সেই কথা। সুকুমার মৃধা কিংবা পি কে হালদারের বাংলো বাড়িগুলো সিল করে দিয়েছে, সেখানে এখন পুলিশ প্রহরা। নিঃসন্তান পি কে হালদারের সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন সুকুমার মৃধার ভাগ্নে ধৃত স্বপন মৈত্র ও তপন ওরফে উত্তম মৈত্র। এদের বাড়িতেও পুলিশ পাহারা। কোনো রকমে কথা বলা সম্ভব হলো স্বপনের স্ত্রী পূর্ণিমা এবং উত্তমের স্ত্রী রচনার সঙ্গে। দু’জনেই স্বীকার করলেন ডুয়েল সিটিজেনশিপ আছে তাদের। অর্থাৎ একইসঙ্গে ভারতীয় নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিক তারা। রচনা-পূর্ণিমার বাড়িতে অশোকনগরে থাকলেই খেতে আসতেন পি কে হালদার। কাকু, চিতল মাছের মুইঠায়া খুব ভালো খেতেন। জানালেন দু’জনেই। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের টিপ পেয়েই এই আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারির নায়ককে ধরেছে ইডি। বিধান রায়, তরুণকান্তি ঘোষ এই স্মৃতিধন্য অশোকনগরের মানুষ বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এতবড় একজন প্রতারক লুকিয়েছিল একদা বৃটিশদের এয়ারবেস এই শহরে। নিবেদিতা পল্লীর এক ভাতের হোটেলের মালিকের কথায়- কে জানতো সর্ষের মধ্যে ভূত!   লোকটা তো স্থানীয় ক্লাবে ভালোই চাঁদা দিতো। টাকা-পয়সাও খরচ করতো। ভরদুপুরে মেঘলা আবহাওয়ার মধ্যে অশোকনগর বোধ হয় ভাবছে মেঘের আড়ালেই মেঘনাদের বাস!।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status