দেশ বিদেশ
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ ঠেকাতে তৎপর নাসিব
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৩ অক্টোবর ২০২২, সোমবারতামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে ‘নাসিব’ নামের একটি সংগঠন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই আইন সংশোধনের উদ্যোগে নাখোশ সংগঠনটি। জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এসোসিয়েশন (নাসিব) আইনটি ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে। ‘প্রস্তাবিত খসড়া আইনের কতিপয় ধারা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন’ জানিয়ে গত ১৮ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লিখেছে সংগঠনটি। নাসিব’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্য বিক্রয়ের জন্য লাইসেন্স গ্রহণের যে প্রস্তাব সংশোধনীতে আনা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১৫ লাখ প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভ্রাম্যমাণ দোকানে বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছে নাসিব। তবে আন্তর্জাতিক তামাকবিরোধী সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডস-এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রয়ে লাইন্সেসিং ব্যবস্থার প্রণয়নও বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকারী পদক্ষেপ, যা এরই মধ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা ও ইইউভুক্ত অনেকগুলো দেশে চালু রয়েছে। এ ছাড়া বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধকরণের যে প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তার বিরোধিতা করে নাসিব জানায়, সিগারেট, বিড়ি ও অন্যান্য তামাকজাত পণ্য সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বৈধ পণ্য এবং রাজস্বের উৎস। প্রস্তাবিত ধারাটি বাস্তবসম্মত নয় দাবি করে নাসিব বলছে, এর ফলে বিক্রয়স্থলে পণ্যের উপস্থিতি ও অপর্যাপ্ততা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এ ছাড়া খুচরা তামাকজাত পণ্য বিক্রয় বন্ধের প্রস্তাবকে ‘অনুচিত ও অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে নাসিব একে প্রান্তিক ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থবিরোধী বলে দাবি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তির ১৩ নং ধারা এবং সংশ্লিষ্ট গাইডলাইনে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন, বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ এফসিটিসিতে স্বাক্ষর করেছে। ২০১৬ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় ঢাকার স্কুলগুলোর আশপাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে স্কুল ও খেলার মাঠের আশেপাশে পরিচালিত অপর একটি সমীক্ষায় ৬৪ দশমিক ১৯ শতাংশ বিক্রয়স্থলে ক্যান্ডি, চকলেট বা খেলনার পাশে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। নেপাল, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং নরওয়েসহ বিশ্বের ৫০টি দেশ ইতিমধ্যে পয়েন্ট অব সেল বা বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়া বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রির ফলে ক্ষতিকর পণ্যগুলো আরও বেশি সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে বিবেচনায় এরই মধ্যে বিশ্বের ১১৮টি দেশ খুচরা শলাকা বিক্রয় এবং ছোট প্যাকেট বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করেছে। নাসিব’র অভিযোগ, প্রস্তাবিত খসড়া আইনে পাবলিক প্লেস/পরিবহন/ রেস্টুরেন্ট/খাবার দোকান/কফি হাউস এবং চায়ের দোকানে ধূমপানের বিষয়টি অস্পষ্ট। এ ছাড়া সংগঠনটি আরও দাবি করেছে, খসড়ায় ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বিলুপ্তিকরণের কথাও বলা হয়েছে, যা অযৌক্তিক। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্টি এলাকা বিলুপ্তিকরণকে বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক উত্তম আচরণ বা ‘বেস্ট প্র্যাকটিসেস’-এর মধ্যে একটি ধরা হয়। পরোক্ষ ধূমপান রোধে কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় ইতিমধ্যে নির্ধারিত ধূমপান এলাকা বাতিল করেছে ৬৭টি দেশ। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশই তামাক সেবন করে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু এবং রোগের চিকিৎসায় বছরে প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়, যা তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্বের তুলনায় অনেক বেশি। তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া এফসিটিসি’র সঙ্গে আরও বেশি সামঞ্জস্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ঘোষণাও দেন তিনি। অন্যদিকে, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (লক্ষ্যমাত্রা ৩-এ) বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ২৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।