ঢাকা, ৮ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বিশ্বজমিন

হারেৎজের বিশ্লেষণ

ইসরাইলিরা কি কখনও গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের দায় স্বীকার করবে?

মানবজমিন ডেস্ক

(১ দিন আগে) ৭ জুলাই ২০২৫, সোমবার, ৪:২০ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০১ পূর্বাহ্ন

mzamin

গত সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় আমি এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বিয়ারের আড্ডায় বসেছিলাম। অস্বাভাবিকভাবে আমাদের কথোপকথন কিছুক্ষণের মধ্যেই বিতর্কে রূপ নেয়। কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে ওঠে। এক অর্থহীন বিষয়ে মতবিরোধ আমাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়, যেন আমরা একে অপরকে কোনো অনৈতিক আচরণের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছি।

বন্ধুটি এরপর বলল, ইরানের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে সে কীভাবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে অংশ নিয়েছিল- যেমন আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ। আমিও পাল্টা বললাম, আমার স্কুলজীবনের কঠিন সময়ের কথা, যখন কাছের একজন ব্রেন ইনজুরির শিকার হয়েছিল। উত্তপ্ত পর্বটি শেষ হওয়ার পর আড্ডা আবার বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু একটা তিক্ততা থেকে গেল।

দুই দিন ধরে অস্থিরতায় ভুগলাম। তারপর এক সকালে ঘুম ভেঙে হঠাৎ করেই মাথায় এলো- আমাদের কথোপকথনের নিচে আসলে চাপা পড়ে ছিল গাজার গণহত্যার দায়। সেই আড্ডায় এই বিষয় একবারও উচ্চারিত হয়নি, যেমন এখন এখানে বেশিরভাগ ছোটখাটো আলাপেই হয় না। কিন্তু আমাদের দু’জনের ওপরই ভেসে ছিল এক ধরনের ভয়ংকর অপরাধবোধ। আর আমরা সেটা সরাসরি মোকাবিলা না করে, বিকৃত কিছু আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে প্রকাশ করছিলাম- কখনো আত্মপ্রশংসা, কখনো আত্মবিলাপ।
এগুলো হল সেই পরিচিত মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া যা দেখা যায় এমন সমাজে যারা গণ অপরাধের দায় চাপা দিতে চায়। অপরাধের কথা না বললেও, আসলে সেটাই বলছে সমাজ। মনোবিশ্লেষক এরান রলনিক জার্মানির যুদ্ধ-পরবর্তী এক ঘটনার কথা বলেছিলেন। এক জার্মান রোগী থেরাপিস্টের কক্ষে ঢুকে হঠাৎ কেঁদে ফেলেন। বলেন, ছয় মিলিয়ন! ভাবতে পারো? ছয় মিলিয়ন ডলফিন মারা গেছে টুনা আর তিমি ধরার নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে। মানুষের নিষ্ঠুরতার কোনো সীমা নেই! সেই রোগীর অবচেতন মন ইহুদিদের বদলে ডলফিন বসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু দেয়ালে দাগটা থেকেই গেছে।

এরপর আমি একটা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম- একটি পরিবারের গল্প। তাদের এক সন্তান ভয়ঙ্কর এক অপরাধ করেছে। ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ভীতসন্ত্রস্ত অভিভাবকরা দ্বিধায় পড়ে যান। একদিকে সত্য মেনে নেওয়ার নৈতিক দায়, আর অন্যদিকে সন্তানকে রক্ষা করার প্রবৃত্তি। এক পর্যায়ে পরিবারের একজন বলেন, মানুষকে তাদের অপরাধের মূল্য দিতে হবে, যেন তারা মানবজীবনে বাঁচতে পারে।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কীভাবে আমাদের অপরাধের মূল্য দেব? আমরা কি কোনোদিন মানবজীবন বাঁচাতে পারব? সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে পপকর্নের বাক্সটা ফেলে দিতে দিতে এ প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল।

ইরান যুদ্ধের সময় আমি মনে করি, আমার ভিতরের কোথাও একটা জায়গায় আশা করেছিলাম- আমার অ্যাপার্টমেন্টে একটা ক্ষেপণাস্ত্র পড়ুক। আমি আহত হতে চাইনি, কিন্তু চাইতাম- এই পৃথিবীটা সহ আমার অস্তিত্ব যেন মিলিয়ে যায়। কয়েকজনকে চিনি যারা একই রকম অনুভব করেছিল। হয়তো সেই জন্যই আমি কখনও নিজের নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করিনি।

এমন অনুভবকে হয়তো অনেকে নিউরোটিক মানুষের সমস্যা বলেই উড়িয়ে দেবে। কিন্তু খুব সম্ভবত, অনেক ইসরাইলিই অবচেতনভাবে একটা শাস্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে পুষে রেখেছিল। এটা হয়তো সেই মানসিক চালিকাশক্তির অংশ, যা ইসরাইলিদের ইরানের সঙ্গে এক বিপজ্জনক যুদ্ধ শুরু করতে প্ররোচিত করেছে, জেনেও যে তার প্রতিশোধে অনেক মানুষ মরবে।

মনোবিশ্লেষণভিত্তিক ব্যাখ্যার সমস্যা হলো, এগুলো কখনও প্রমাণ করা যায় না। তাছাড়া, উপরের স্তরে আজকের ইসরাইল যেন কোনো অপরাধবোধই দেখায় না। গাজায় মৃত্যু ১ লাখ ছুঁইছুঁই। তবুও গণহত্যার পর্দা উন্মোচিত হওয়ার পরও সামাজিক বিবেক নিশ্চুপ। স্থানীয় মিডিয়া ও জনমত নিজেদের ন্যায্যতা নিয়েই বিভোর এবং সামান্য সমালোচনাকেও তারা ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ বলবেন, এই প্রত্যাখ্যানই একধরনের হিস্টেরিক ডিফেন্স মেকানিজম, যা একদিন সত্যের মুখে ভেঙে পড়বে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল।

প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, গাজায় দায়িত্বপালনকারী অনেক সেনা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে ভুগবে। কিন্তু সাধারণ ইসরাইলিদের আচরণে তা বোঝার উপায় নেই। অবশ্য, (২০২৩ সালের) ৭ অক্টোবরের হামলার ভয়াবহতাও আমাদের গায়ে দাগ কেটে দিয়েছে, যেটা আমরা সহজে মুছতে পারব না। তবুও, ইসরাইলি সমাজ আদৌ গাজার ধ্বংসযজ্ঞের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করবে কি না, তা অনিশ্চিত।

ইতিহাস এখনও শেষ হয়নি
ইতিহাস বলে, গণহত্যা বা যুদ্ধাপরাধ নিয়ে সার্বিক দায় স্বীকার সাধারণত ঘটে না। অনেকে জার্মান সমাজের দিকে তাকিয়ে বলেন- হ্যাঁ, সেখানে গণহত্যার স্মরণ আজ জাতীয় পরিচয়ের অংশ। কিন্তু মনে রাখা উচিত, জার্মানিতে আসল নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৯৬০ দশকের শেষদিকে, অনেক সময় পর। সেটাও হয়েছিল মূলত তরুণ প্রজন্মের বিদ্রোহের মাধ্যমে, যারা নিজেদের অভিভাবকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিল। অথচ তখনও অধিকাংশ জার্মান নিজেদের নাৎসী শাসনের শিকার, মিত্র বাহিনীর বোমাবর্ষণ বা সোভিয়েত দখলের ভুক্তভোগী হিসেবেই দেখছিল। যদিও বিবেক কাঁদছিল, তা তাদের ভোগবাদী জীবন থেকে বিরত রাখেনি।

অন্যত্র চিত্র আরও হতাশাজনক। জাপান তার যুদ্ধাপরাধ, বিশেষ করে চীন ও কোরিয়ার বিরুদ্ধে, কখনও পুরোপুরি মেনে নেয়নি। কারণ, তারা নিজেদের পারমাণবিক বোমার শিকার হিসেবেই বেশি দেখেছে। বলকান অঞ্চলে বা তুরস্কে- যেখানে আর্মেনিয়ান গণহত্যা এক শতাব্দী ধরে অস্বীকার করা হয়- সেই চর্চা আজও নেই। এখনই নিশ্চিত করে বলা যায়, গাজার ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়াও হবে একই রকম আত্মবঞ্চনার। ভবিষ্যতে ইসরাইলের ওপর কী বিপদ আসবে, কে জানে? ইতিহাস এখনো শেষ হয়নি।

সম্ভবত দুটি গোষ্ঠী এই অপরাধবোধ নিয়ে লড়াই করবে। তারা হলো এক. সেনাদের মধ্যে যারা সংবেদনশীল, তাদের পক্ষে সমাজের প্রচলিত আত্মপক্ষ সমর্থনে শান্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। দুই. শিক্ষাবিদ ও শিল্পীরা যারা আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল চর্চার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সবার আগে আমাদের এই ভয়াবহতা থেকে সত্যিকারের মুক্তি পেতে হবে। তারপরই দায় স্বীকারের প্রসঙ্গ আসতে পারে।
(অনলাইন হারেৎজ থেকে অনুবাদ) 
 

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান/ একাধিক দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত

নেতানিয়াহুর ভূয়সী প্রশংসা করলেন ট্রাম্প/ ইরানের ৩ পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status