দেশ বিদেশ
৩ বছরের প্রকল্পে ১৪ বছর পার
সুদীপ অধিকারী
২২ জুন ২০২৫, রবিবাররাজধানীবাসীর ভোগান্তি কমাতে ২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার কাওলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১১ সালের ১৯শে জানুয়ারি এই প্রকল্পের জন্য তিনটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এরপর ২০১৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-ভিত্তিক প্রকল্পটির চুক্তি সংশোধন করে ৩১টি র্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়। যার মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ পড়ে প্রায় ১৯০ কোটি টাকার উপরে। ৩ থেকে সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ বছরেও পুরোপুরি শেষ হয়নি এর নির্মাণকাজ। অপরিকল্পিত একাধিক র্যাম্পে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থলগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলমান রয়েছে। প্রথম ধাপে ২০২৩ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এলিভেটেড অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন গেইট পর্যন্ত র্যাম্পসহ মোট ২১ দশমিক ৮১ কি.মি. দীর্ঘ এলিভেটেড অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে বিএফডিসি থেকে কুতুবখালী রুটের কাজ চলছে কচ্ছপ গতিতে।
সরজমিন দেখা যায়, তিন ধাপে এই প্রকল্পের ১ম ধাপে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা হতে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কি.মি. দৈর্ঘ্য ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হয়েছে। তবে ২য় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কি.মি দৈর্ঘ্য কাজের মধ্যে শুধুমাত্র বিএফডিসি পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হয়েছে। ২য় অংশের মগবাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। বাকি মগবাজার রেলক্রসিং থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত অবশিষ্টাংশের কাজ ১০ মাস বন্ধ থাকার পর স্বল্প পরিসরে চালু হয়েছে। অল্প শ্রমিক নিয়ে মগবাজার রেলক্রসিং এলাকায় চলছে পিলার নির্মাণের কাজ। সিরাজুল ইসলাম নামে মগবাজারের এক বাসিন্দা বলেন, আগে যে গতিতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণযজ্ঞ চলছিল, শত শত শ্রমিক কাজ করতো তেমন কিছুই এখন দেখা যায় না। আর্থিক সংকটে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আইনি জটিলতায় অনেকদিন কাজ বন্ধ ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এক কর্মচারী বলেন, আমি প্রায় ৩/৪ বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছি। আগে অনেক শ্রমিক ছিল। কিন্তু গত বছরের শুরুর দিকে ঠিকাদার কোম্পানিদের বিবাদে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দেয়। আর্থিক সংকটের কথা বলে হঠাৎ বেশির ভাগ শ্রমিককে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হয়। বলা হয়- প্রকল্প আবার পুরোপুরি চালু হলে তোমাদেরকে আবারো ডাকা হবে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আগের মতো ঢিমেতালে কাজ চলছে। এখন শোনা যাচ্ছে- ঠিকাদার কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঝামেলা মিটেছে। কাজ নাকি পুরোদমে শুরু হবে। কিন্তু কবে হবে তা বলা যাচ্ছে না। এদিকে কেউ কেউ বলছেন- পিপিপি প্রকল্প শহরকে বাইপাস করার কথা থাকলেও যত্রতত্র র্যাম্প করায় তা ফ্লাইওভারে পরিণত হয়েছে। ওঠা-নামার র্যাম্পগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চালু হওয়া র্যাম্পগুলোতে যানবাহন ওঠা-নামা পয়েন্টগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কর্মব্যস্ত বেশির ভাগ দিনেরই সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যায় তীব্র যানজট লেগে থাকছে। যানজট মাড়িয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উঠতে ও নামতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির মধ্যে বসে থেকে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। যার চাপ নিচের সড়কগুলোতেও পড়ছে।
সেতু ভবন বলছে, পিপিপি প্রকল্পগুলোতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পুরো টাকা বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও ভায়াবিলিটি গ্যাপ (ভিজিএফ) নামে এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারও প্রায় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। যা মোট প্রকল্পের ২৭ শতাংশ। আর মূল কাঠামোর নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগানের জন্য তিনটি বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রকল্প বর্ণনাতে দেখা যায়, শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ৫১ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী ইতালিয়ান থাই (ইতালথাই) ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি। তবে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্বে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ও অক্টোবরে সিঙ্গাপুরে আইনি লড়াইয়ে ইতালথাই হেরে যাওয়ায় তাদের শেয়ার নিয়েছে অপর অংশীদার চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ। বর্তমানে শেনডংয়ের শেয়ার ৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৫ শতাংশ হয়েছে। বাকি ১৫ শতাংশের শেয়ারহোল্ডারের মালিক সিনো হাইড্রো করপোরেশন লি.। ২০ কি.মি. দৈর্ঘ্যের এই মূল এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য ১৫টি এবং নামার জন্য ১৬টি মোট ৩১টি র্যাম্প সংযুক্ত হবে। এই র্যাম্পের দৈর্ঘ্যই ২৭ কি.মি.। এগুলো হলো- বিমানবন্দর, কুড়িল, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, বিজয় সরণি, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া ও পলাশী মোড়। আর নামার র্যাম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিমানবন্দর, কুড়িল, সেনানিবাস, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, সোনারগাঁও রোড, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া, ইন্দিরা রোড এবং পলাশী মোড়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, অতি ব্যয়বহুল ও বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প নেয়ার প্রবণতা থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সড়ক পরিবহন পরিকল্পনায় ব্যয় সাশ্রয়ী, টেকসই, গণপরিবহনকেন্দ্রিক, জনবান্ধব ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সহনশীল সমাধানকেই অগ্রাধিকার দেয়া দরকার।
এবিষয়ে সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাকি কাজও চলমান রয়েছে। তবে কিছুটা ধীরগতিতে। এই মাসের শেষ দিক থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হবে। আশা করছি- ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে পুরো প্রকল্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া যাবে।