ঢাকা, ১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

দেশ বিদেশ

সুঁই-সুতার জীবনযুদ্ধ

সোহেল রানা, আশুলিয়া থেকে
২১ জুন ২০২৫, শনিবার
mzamin

ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত আশুলিয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমে নিজেদের এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন। তাদের জীবন-জীবিকা মিশে আছে সুঁই-সুতা আর কাপড়ের বুননে। যা কেবল পোশাক নয়, বুনছে তাদের স্বপ্ন আর টিকে থাকার গল্প। এখানকার শ্রমিকদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসী। গ্রামীণ জীবনের টানাপড়েন আর অভাব তাদের ঠেলে দিয়েছে এই শিল্পনগরীতে। একটি ভালো জীবনের আশায়, নিজেদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে তারা বেছে নিয়েছেন কঠিন পথ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানার নির্দিষ্ট ছন্দে চলে তাদের জীবন। কখনো ওভারটাইমের চাপ, কখনো উৎপাদন লক্ষ্য পূরণের তাড়া। সবকিছু ছাপিয়ে তারা অবিচল থাকেন নিজেদের কাজে।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং পরিশ্রম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ শ্রমিকের কাছে এটাই একমাত্র আয়ের উৎস। একজন শ্রমিক সাধারণত মাসে ৮-১২ হাজার টাকা আয় করেন। যা দিয়ে তাদের নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানোর পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে থাকা পরিবারের কাছেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। অল্প টাকায় জীবনযাপন করা তাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। কারখানার আশপাশে গড়ে ওঠা স্বল্প ভাড়ার খুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় অনেককে। যেখানে আলোর স্বল্পতা, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা নিত্যদিনের চিত্র। স্বাস্থ্যসেবা তাদের জন্য এক বড় উদ্বেগের বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে কাজ করা, মেশিনের শব্দের মধ্যে থাকা এবং রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসার কারণে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, মেরুদণ্ডের ব্যথা এবং চোখের সমস্যা তাদের নিত্যসঙ্গী। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ খুব কম শ্রমিকেরই হয়। জরুরি প্রয়োজনে সরকারি হাসপাতালের লম্বা লাইন বা উচ্চমূল্যের বেসরকারি চিকিৎসা তাদের নাগালের বাইরে।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়া তাদের সন্তানদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। অনেক শ্রমিকের সন্তানরা তাদের সঙ্গে আশুলিয়াতেই থাকে। কিন্তু বাবা-মায়ের সীমিত আয়ে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া তাদের জন্য বিলাসিতা। কেউ কেউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেলেও উচ্চশিক্ষা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। ফলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে দারিদ্র্যের চক্রাবর্ত চলতে থাকে। গার্মেন্টস শিল্পের এ শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মজুরি বৃদ্ধি, কর্মপরিবেশের উন্নতি, ওভারটাইম ভাতা এবং ছুটির দাবি নিয়ে তাদের আন্দোলন প্রায়শই সহিংস রূপ নেয়। অনেক সময় এই আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়, যা তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। তবে, এই সংগ্রামের মাধ্যমেই শ্রমিকরা একত্রিত হতে শিখেছেন এবং নিজেদের দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন।

আশুলিয়ার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন কেবল অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশে সীমাবদ্ধ নয়। তাদের জীবন গল্প বলে অধ্যবসায়, আত্মত্যাগ আর টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছার। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করলেও তাদের জীবনমান উন্নয়নে এখনো অনেক পথ বাকি। তাদের কাজের ন্যায্য স্বীকৃতি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, মানসম্মত আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তাদের জীবন-জীবিকার মান আরও উন্নত হবে এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।

আশুলিয়ার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ: 
আশুলিয়ার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (ঘএঙ) নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। যদিও চ্যালেঞ্জের শেষ নেই, তবুও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তাদের অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করছে।

সরকারি উদ্যোগ- 
সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে। শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা, ছুটি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সরকার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করেছে, যা পর্যায়ক্রমে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা তাদের আর্থিক সচ্ছলতায় কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে।
শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন শিল্প এলাকায় শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শ্রমিকরা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন। এ ছাড়াও, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ঘঝউঅ) গঠন করেছে। এই কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে, যা তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং উন্নত বেতনের পথ সুগম করে।

বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা-
বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (ঘএঙ) আশুলিয়ার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই সংস্থাগুলো মূলত কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করে-
শ্রমিক অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধি: অনেক ঘএঙ শ্রমিকদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। তারা কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, মজুরি বঞ্চনা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবের মতো বিষয়গুলো নিয়ে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের প্রতিবাদ করার জন্য সংগঠিত হতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি সহায়তা: কিছু ঘএঙ বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনা করে, যেখানে শ্রমিকরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ওষুধ পান। তারা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের মধ্যে পুষ্টি বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করে।
শিক্ষা ও শিশু যত্নের সুযোগ: শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিছু ঘএঙ স্বল্প খরচে বা বিনামূল্যে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়াও, কর্মজীবী মায়েদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করে, যা শিশুদের নিরাপদ পরিবেশ এবং মায়েদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়।

আবাসন ও স্যানিটেশন: কিছু ঘএঙ শ্রমিকদের জন্য উন্নত আবাসন এবং স্যানিটেশন সুবিধার উন্নয়নে কাজ করে, যদিও এটি এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই শিল্পাঞ্চল কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ জীবন মানবজমিনকে জানান, শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও তাদের জীবনমানের কোনো উন্নয়ন হয়নি। স্বাস্থ্যসেবার নামে লোক দেখানো মেডিকেল টিম নিয়ে চলছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া, লাখ লাখ শ্রমিকের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা নেই। ফলে শিশু সন্তানদেরকে ঘরে রেখেই কারখানায় ছুটতে হয় মা-বাবাকে। এতে যেমন নিরাপত্তাহীনতায় থাকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের শিশুরা, তেমনি বিভিন্ন সময় তারা অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হয়। 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status