দেশ বিদেশ
উদ্বেগ-আতঙ্ক
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দীর্ঘ হচ্ছে মানুষের লাইন
মোহাম্মদ আবুল হোসেন
১৮ জুন ২০২৫, বুধবার
বিমানবন্দরে বোমা হামলা। পারমাণবিক স্থাপনায় আগুন। তেল ডিপোতে বোমা বিস্ফোরণের পর আগুনের শিখা আকাশমুখী। হত্যা করা হয়েছে রেভ্যুলুশনারি গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি, সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হোসেইন বাঘেরিসহ শীর্ষ স্থানীয় সামরিক ও প্রতিরক্ষা খাতের কর্মকর্তাদের। হত্যা করা হয়েছে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের। এরপর সরাসরি সম্প্রচারকালে রাষ্ট্রীয় টিভি স্টেশন আইআরআইবি’তে বোমা হামলা এবং তাতে দু’জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে হামলা করা হয়েছে। এমন এক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কয়েকদিন ধরেই ইরানি জনগণকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উস্কানি দিয়েছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সহ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এই আহ্বানে যোগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনও। তারা চায় ইরানে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন। এমন টার্গেট নিয়ে তারা শুক্রবার রাত থেকে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সোমবারও রাজধানী তেহরানে সামরিক ও মিডিয়া হাউজের কাছাকাছি অবস্থানরত জনগণকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরাইল। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও জোরালো হয়ে ওঠে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তাদের স্রোত চলতে শুরু করে বিভিন্ন সড়ক ধরে। এতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়।
পেট্রোল স্টেশন ও বেকারিতে দেখা দেয় দীর্ঘ লাইন। তাদের সামনে একের পর এক এগিয়ে আসতে থাকে আতঙ্কের রাত। এ অবস্থায় ইরানিরা আকুতি জানাচ্ছেন, সুন্দর এই তেহরানকে আরেকটি গাজায় পরিণত হতে দিও না। কিন্তু তাদের সেই আহ্বান বিশ্বনেতাদের কানে কতোটুকু প্রবেশ করছে তা নিয়ে আছে সংশয়। তেহরানের বাসিন্দারা শুক্রবার ভোর থেকে ইসরাইলের হঠাৎ হামলায় এখনো স্তব্ধ। তারা বলছেন- ভয়, বিভ্রান্তি, অসহায়ত্ব এবং দ্বিধান্বিত আবেগের কথা। তাদের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও এখন সবাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। ফলে রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থি সরকারের কড়া সমালোচক, বিরোধী গ্রুপ ও মতের সব মানুষ দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখাচ্ছেন- যখন তাদের সম্পদ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ২১ বছর বয়সী সংগীতের এক ছাত্রী বলেন, আমরা অনেক রাত ধরে ঘুমাতে পারিনি। সবাই পালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যাচ্ছি না।
আমার বাবা বলেন, নিজের ঘরে মরাই বেশি সম্মানের। ‘দোন্যা’ (ছদ্মনাম) এমন অনেক ইরানির একজন। তারা এখন এমন এক যুদ্ধে আটকা পড়েছেন যার একদিকে রয়েছে এমন একটি শাসনব্যবস্থা যাকে তিনি ঘৃণা করেন। অন্যদিকে রয়েছে ইসরাইল। গাজার উপর ইসরাইলের ধ্বংসাত্মক গণহত্যার দৃশ্য টিভির স্ক্রিনে দেখেছেন দূর থেকে। তিনি বলেছেন, আমি একেবারেই চাই না যে, আমার সুন্দর তেহরান গাজার মতো হয়ে যাক।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানিদের তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছে। এমন আহ্বানের জবাবে দোন্যা বলেন, আমরা চাই না ইসরাইল আমাদের উদ্ধার করুক। কোনো বিদেশি দেশ কখনোই ইরানের জন্য কিছু করেনি। আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রও চাই না। আরেকজন নারী প্রথমে কিছুটা ‘অদ্ভুত উত্তেজনা’ অনুভব করছিলেন যখন ইসরাইল এমন সব ইরানি সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে- যাদের তিনি চিরজীবী মনে করতেন। তিনি বলেন, হঠাৎই শক্তির সেই চিত্র ভেঙে পড়লো। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে যখন শুনলাম সাধারণ মানুষ- যাদের আমি চিনিও না, আমার মতো মানুষ -তারাও মারা গেছেন, তখনই আমার মধ্যে শোক, ভয় ও দুঃখ বাসা বেঁধেছে। তিনি বলেন, তার সেই দুঃখ রূপ নেয় রাগে যখন তিনি শুনলেন দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে আঘাত হেনেছে ইসরাইল। তিনি আশঙ্কা করেন ইসরাইল ইরানকে ‘ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত করতে চায়। প্রথমবারের মতো, তিনি মৃত্যুর সম্ভাবনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। ইরানি কর্তৃপক্ষের মতে, শুক্রবার থেকে কমপক্ষে ২২৪ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরাইল। তাদের অনেকেই নারী ও শিশু।
অন্যদিকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বলছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রে কমপক্ষে ২৪ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এরই মধ্যে ইসরাইলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তার পুরোটা মিডিয়ার খবরে আসছে না। যুদ্ধ শুরুর একদিন পরে শনিবার ভোরেই খবর আসে যে, সাধারণ ইসরাইলিরা পালাচ্ছে। সরকার তাদেরকে বাংকারে আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যে যেভাবে পারে খাবার জড়ো করে মাটির নিচে বা ভূগর্ভস্থ কোনো আস্তানায় তারা আশ্রয় নিতে থাকে। কিন্তু ইরানে এমন কোনো আগাম সতর্কতা নেই, নেই কোনো বাংকার বা নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে রাজধানী তেহরান, ইস্ফাহান, কেরমানসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছিলেন। তার মধ্যেই ইসরাইলের ভয়াবহ হামলায় চারদিকে আগুন জ্বলতে থাকে। রাজধানীতে ভূগর্ভস্থ পানির লাইন বিধ্বস্ত হয়ে রাস্তা প্লাবিত হয়। এর মধ্যে ইসরাইল থেকে আগাম সতর্কতা দেয়া হয়। লোকজনকে রাজধানী, পারমাণবিক স্থাপনা, তেলক্ষেত্র, সামরিক স্থাপনা, অস্ত্র তৈরির স্থাপনা সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের আশপাশ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না ইসরাইল ও তাদের মদতদাতারা।
তারা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সেন্টার, হাসপাতালকে তোয়াক্কা করছে না। যেমন গাজায় তারা তাদের ইচ্ছামতো মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে, এর জন্য কারও কাছে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না- ঠিক একই লক্ষ্য কী ইরানের জন্য নির্ধারণ করেছে ইসরাইল? তারা যে ইরানিদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছে, দৃশ্যত তারাই উল্টো দেশপ্রেমের কারণে, ইসরাইলের অসৎ উদ্দেশ্য দেখে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। দেশের সম্পদ ধ্বংস হতে দেখে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের লাশ হতে দেখে তারা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছেন। তবু যারা যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি যুদ্ধ করছেন না, সেইসব সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া শুরু করেন। তার মধ্যেই আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ছে, আর তেহরানে গাড়ি বোমার একটি প্রচারণা আরও আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। ইসরাইলি ও ইরানি উভয় দেশের সংবাদমাধ্যমেই এ খবর এসেছে। দোন্যা নামের সেই তরুণী আগে সরকার ও এর কঠোর পোশাকবিধি উপেক্ষা করে খোলা চুলে বাইরে যেতেন। এখন পরীক্ষাগুলো এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাওয়ায় ঘরেই আছেন। তিনি বলেন, রাতে আমি খুব ভয় পাই। ঘুমানোর জন্য ওষুধ সেবন করি। সরকার জনগণকে মসজিদ ও মেট্রোস্টেশনে আশ্রয় নিতে বলেছে। কিন্তু বাস্তবে তা কঠিন, যখন বিস্ফোরণগুলো হঠাৎই ঘটে। তেহরান একটা বিশাল শহর, কিন্তু প্রতিটি এলাকাই কিছু না কিছু ক্ষতির মুখে পড়েছে। আরেক ইরানি তরুণী এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, আমরা প্রতি ঘণ্টায় খবর চেক করি, আর যেসব আত্মীয়ের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ফোন দিয়ে বেঁচে আছেন কিনা দেখি। তিনি ও তার পরিবার এখন এমন একটি এলাকায় চলে গেছেন, যেখানে কোনো সরকারি ভবন নেই। কিন্তু ইরানের মতো দেশে কে পাশের বাসিন্দা, তা কখনো জানা যায় না। হয়তো তার পাশেই টুপ করে বসে আছে মোসাদের এজেন্ট। তিনি বলেন, ইসরাইলি হামলা ইরানিদের বিভক্ত করেছে। কেউ কেউ সরকারের ক্ষতিতে আনন্দ করছে, আবার কেউ এই সমর্থনকারীদের ওপর রেগে যাচ্ছেন। অনেক ইরানি তাদের মত বদলাচ্ছেন, একেক পরিবারে বিভক্তি চরমে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি টাইটানিক জাহাজ হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়ার প্রথম ঘণ্টাগুলোর মতো। কেউ পালাচ্ছে, কেউ বলছে কিছু হয়নি, আর কেউ নাচছে।
ওই তরুণী সবসময় ধর্মীয় শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু নেতানিয়াহু যা করছে, তা ‘অমার্জনীয়’ বলেই মনে করেন। বলেন, যেই হোক হামলাকে সমর্থন করুক বা না করুক, সবার জীবনই চিরতরে বদলে গেছে। এখন বেশির ভাগ ইরানি, যারা সরকারবিরোধী তারাও বুঝে গেছে, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আসে না এমন বোমা থেকে, যা নিরস্ত্র নাগরিকদের শহরের ওপর পড়ে। তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা ওষুধ, খাবার ও পানি দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি, যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়!
ইসরাইল বলছে, ইরানি সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক ভবন ও এলাকায় অস্ত্র ও কমান্ড সেন্টার রাখছে। ইরানি বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ইয়াসামিন আনসারী বলেছেন, তেহরান থেকে সবাইকে সরিয়ে নিতে ট্রাম্পের পরামর্শ ‘নির্দয় ও ভীতিকর’। তেহরান প্রায় এক কোটি মানুষের বিশাল শহর। ইরানিরা অবশ্যই স্বাধীনতা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যার হুমকি, গণহত্যা কিংবা আরেকটি যুদ্ধ এর উত্তর হতে পারে না।
ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ ফাউন্ডেশনের নীতিনির্ধারক বেঞ্জামিন ফ্রিডম্যান বলেন, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা একরকম কয়েন ছোড়ার মতো- হ্যাঁ বা না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো মূল্যে তা এড়ানো উচিত। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে এটি হবে একটি বিপর্যয়। একটি সম্ভাব্য পথ হলো- ইরান যদি মার্কিন ঘাঁটি, কর্মী বা মধ্যপ্রাচ্যের তেল পরিকাঠামোর ওপর হামলা চালায়, তবে মার্কিন প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। তবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও তার শীর্ষ সহযোগীদের ইসরাইল-ঘনিষ্ঠতা এই যুদ্ধকে আরও এগিয়ে নিতে পারে। আমি আশা করি- তা হবে না। এটি একটি শাসন পরিবর্তনের যুদ্ধ, যা ব্যর্থ হবেই এবং আমি আশা করি ট্রাম্প প্রশাসন সেটা বুঝবে। ওদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভাবছেন ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রে হামলা চালাতে। এই স্থাপনায় আঘাত হানতে প্রয়োজন হবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাঙ্কার-ধ্বংসকারী বোমা- মাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর যা বি-২ বোমার মাধ্যমে ফেলা হয়।
যদি তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের এক নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। এটি হবে এমন এক যুদ্ধ, যা ট্রাম্প দুইবারের নির্বাচনী প্রচারে এড়িয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।