দেশ বিদেশ
গুলি-বোমা-ভয়ভীতি দেখিয়ে থামানো যাবে না গণহত্যার বিচার
স্টাফ রিপোর্টার
১৮ জুন ২০২৫, বুধবারগুলি করে, বোমা ফাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায়বিচার থেকে দূরে সরানো যাবে না। বিচারের এই তরী বেয়ে নিয়ে যাবো তীরে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দীর্ঘ ১১ মাস পরে যাত্রা শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গতকাল প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনাল-২ এর এজলাসে বসেন ৩ বিচারপতি। রীতি অনুযায়ী এদিন অ্যাটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং অপর ২ জন সদস্য মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীরকে এজলাস কক্ষে এ সংবর্ধনা দেয়া হয়। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বক্তৃতা করেন।
সংবর্ধনায় ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে পক্ষপাতিত্বহীন ভাবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এই বিচার করতে সচেষ্ট থাকবো। গুলি করে, বোমা ফাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায়বিচার থেকে দূরে সরানো যাবে না। কেউ গুলি করে মেরে ফেললে আমার সব গুনাহ নিয়ে যাবে। আল্লাহ সহায়, ভয়ের কিছু নেই। আমি কবরের পাশে দাঁড়ানো, আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। বিচারের এই তরী বেয়ে নিয়ে যাবো তীরে। তিনি আরও বলেন, শত শত ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে মানুষকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। তাদের অনেকে এখনো যথাযথ চিকিৎসা পাননি। বিচারকেরা চেষ্টা করছেন ছাত্র-জনতার দুর্ভোগ কমাতে। এসময় বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ট্রইব্যুনালের বিচারকাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে অ্যাটর্নি জেনারেল ও চিফ প্রসিকিউটর সহ সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কেউ যেনো বিচারের মান নিয়ে আর প্রশ্ন তুলতে না পারে। ফ্যাসিবাদ যেনো আর ফিরে আসতে না পারে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এই বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে। আমরা দেখতে চাই এই বিচার যেন হয় আন্তর্জাতিক মানের। জাতি ন্যায়বিচারের যে প্রত্যাশা করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আজকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনায় এজলাসে বসা শুরুর মধ্যদিয়ে ট্রাইব্যুনাল-২ এর যাত্রা শুরু হলো। ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে কিছু মামলা এখানে আসবে বলে আশা করছি। আর কিছু নতুন মামলা এখানে দাখিল করবো। এর মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল সম্পূর্ণ ভাবে কার্যকর হবে। তিনি বলেন, যেহেতু ট্রাইব্যুনালে অনেকগুলো মামলা দাখিল হয়েছে, সুতরাং একটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এতগুলো মামলা নিষ্পত্তি করা কঠিন হবে। সেই বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করা হয়েছে। আমরা মামলাগুলো ভাগ করে দু’টি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে যেনো একই সঙ্গে অনেকগুলো মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়া যায়। ইনশাআল্লাহ, আগামী দিনে বিচারের অগ্রগতি দেশবাসী এবং জাতি দেখতে পাবে।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিফ প্রসিকিউটরের আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল-১ আদেশের পরে ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলাগুলো নেয়া হবে। এ ছাড়া নতুন মামলা দাখিলের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল-১ এর আদেশের প্রয়োজন নেই। প্রসিকিউশন যে মামলাগুলো দরকার মনে করবে সেগুলো সরাসরি ট্রাইব্যুনাল-২ এ দাখিল করা হবে বলে জানান তাজুল ইসলাম। এ ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আইসিটি-বিডি কেস নাম্বার-১ মামলাটির কার্যক্রম যেহেতু ট্রাইব্যুনাল-১ এ চলমান রয়েছে, সুতরাং এ মামলাটির বিচার এখানেই চলবে বলে জানান তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছর যদি কেউ সরকারের সমালোচনা কিংবা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতো, তাদেরকে গুম করে ফেলা হতো। গুম করে তাদের বছরের পর বছর বিনাবিচারে আটকে রাখা হতো। পরিবারকে কোনো তথ্য দেয়া হতো না। তাদেরকে নির্যাতন করা হতো, চোখ বেঁধে অন্ধকার ঘরে ৮ বছর বন্দি করে রাখার মতো দৃষ্টান্ত আমরা পেয়েছি। অনেককে আবার গুম করে, হত্যা করে, পেট চিড়ে, সিমেন্টের বস্তা বেঁধে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা অথবা দেশের বিভিন্ন নদীতে ফেলে দেয়া হতো। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে গুমকে যে রাজনৈতিক কালচারে পরিণত করা হয়েছিল সেটি থেকে বাংলাদেশকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। এই কালচারটি বন্ধ করার প্রথম কাজটি করেছে ছাত্রদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সংগঠিত জুলাই বিপ্লব। আগামীতে যাতে কখনোই এমন অন্ধকার জগৎ ফিরে না আসে। নাম্বার প্লেটবিহীন গাড়ি এসে কাউকে তুলে নিয়ে যাবে এমন অপরাধ থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হলে, পেছনে ঘটে যাওয়া সকল অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। সেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যই ট্রাইব্যুনালগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা যেনো, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ঠিক রেখে ন্যায়বিচার শেষ করতে পারে- ট্রাইব্যুনালের কাছে এটা আমরা প্রত্যাশা করি।
উল্লেখ্য, গত ৮ই মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে সরকার। এই ট্রাইব্যুনালের সদস্য পদে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং মাদারীপুরের জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান ও সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের প্রাপ্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া প্রজ্ঞাপনে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।