দেশ বিদেশ
এবারের বাজেট ট্রাম্প ও আইএমএফকে খুশি করার বাজেট: আনু মুহাম্মদ
স্টাফ রিপোর্টার
১৫ জুন ২০২৫, রবিবার
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ‘ট্রাম্প প্রশাসন ও আইএমএফকে খুশি করার বাজেট’ বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এবারে বাজেটে আইএমএফ ও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ট্রাম্প ও আইএমএফ- এই দুই পায়ের উপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট। শনিবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি আয়োজিত ‘বাজেট: দেড় দশকের অভিজ্ঞতা ও অর্থনীতির গতিপথ’- শীর্ষক আলোচনা সভায় সভাপ্রধান হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় আরও বক্তব্য দেন আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ার ড. গোলাম রসুল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহা মির্জা, চিকিৎসক ডা. হারুন অর রশীদ, লেখক-গবেষক প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ও মাহতাব উদ্দীন আহমেদ। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, এবারের বাজেটে আমরা যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করলাম, সেটি হচ্ছে আইএমএফের প্রভাব। ক’দিন আগে প্রধান উপদেষ্টা আইএমএফের বেশ প্রশংসাও করছেন। বাজেটে ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি প্রভাব দেখলাম আমরা। ট্রাম্প এবং আইএমএফের এই দুই পায়ের উপর দাঁড়ানো এবারের বাজেট।
ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, দেশীয় শিল্পের মধ্যে যারা ক্ষুদ্র শিল্প, স্থানীয় শিল্প- অনেক রকম শিল্প কিন্তু যারা নিজেরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, আইএমএফের প্রভাবে আমরা দেখলাম স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা অনেক রকম বাতিল হয়েছে, গৃহস্থালির বিভিন্ন জিনিসপত্রের ওপর কর আরোপ করা হয়েছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে দেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। করোনার সময় এটার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আইটি, ফ্রিল্যান্স যারা করে তাদের ওপর নতুন করে কর স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো সবই করা হয়েছে আইএমএফের পরামর্শে।
তিনি আরও বলেন, আইএমএফ বলেছে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে, ট্যাক্স বাড়াতে গিয়ে ভ্যাট বাড়িয়েছে, এর ফলে ছোট ছোট শিল্পগুলোর ওপরই চাপটি পড়ছে। আর এই চাপটি আরও বাড়ছে ট্রাম্প সাহেবকে খুশি করার কারণে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে একটি বিশ্ব উন্মাদনা তৈরি করছে। ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক করলো। তারা অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে আমদানি রপ্তানির ব্যবধান যেখানে বেশি সেখানে বাড়তি ট্যারিফ আরোপ করেছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এখানে কম রপ্তানি করে ও আমাদের থেকে বেশি আমদানি করে, সেটার জন্য কি আমরা দায়ী? তাদের দেশ থেকে পণ্য আনার মতো নেই সে কারণেই এমনটি ঘটছে। এই ব্যবধান যদি কমাতে হয়, তবে তাদেরকেই রপ্তানিযোগ্য পণ্য বাড়াতে হবে। সে না করে গায়ের জোরে, সম্পূর্ণ গায়ের জোরে সারা পৃথিবী ট্রাম্প প্রশাসন ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করেছে। এই উন্মাদনা তৈরি করে আবার তা কয়েকদিনের জন্য পেছালো। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণা প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর বাংলাদেশের দিক থেকে তড়িঘড়ি করে ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার চেষ্টা দেখা গেল। সেই খুশি করতে গিয়ে এবারের বাজেটে ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখা গেল। আমদানিকৃত অনেক পণ্যে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অনেকগুলো পণ্যের শুল্ক কমবে- তারমধ্যে পরিশোধিত আমদানি চিনি, বিদেশি মাছ-মাংস, বিদেশি কাপড়-পোশাক, বিদেশি পাস্তা, বিদেশি প্লাস্টিক। দেশি প্লাস্টিকের ওপর কর আরোপ করা হয়েছে, এটি খুবই যুক্তিসঙ্গত, কারণ প্লাস্টিক আমাদের কমাতে হবে। কিন্তু বিদেশি প্লাস্টিক আনলে আবার শুল্ক কম, বিদেশি প্লাস্টিকে কোনো সমস্যা নেই, দেশি প্লাস্টিকে সমস্যা, হাসপাতালের যন্ত্র, আমদানি ওষুধ, ওষুধের কাঁচামাল, কৃষি যন্ত্রাংশে শুল্ক কমেছে।
মার্কিন প্রশাসনকে খুশি করতে বাজেটে নেয়া বেশ কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার, ৬৫টি পণ্যে শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার, ৪৪২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক হ্রাস, যুদ্ধাস্ত্র আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য শুল্ক, পেট্রোলিয়াম পণ্য, এলএনজি আমদানির ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই যে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। আবার আমদানি পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। এর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ফলে দেশীয় শিল্পে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে ও কর ছাড় কমানো হয়েছে। আমাদের আরও আমদানিনির্ভর করার ও আরও ঋণ নির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশীয় শিল্পের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করা হয়েছে।
বাজেটে আয়ের জন্য ভ্যাট ট্যাক্স বাড়ানোর কথা বলা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মার্কিন কোম্পানির কাছে আমাদের যে ক্ষতিপূরণ তা আদায় করার কথা বলা হয় না। মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাস বিস্ফোরণে যে ক্ষতি হয়েছিল, সেখানে মার্কিন কোম্পানি জড়িত ছিল। সেই ক্ষতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা ও ক্ষতিপূরণ আদায় করা অন্তর্বর্তী সরকারেরও দায়িত্ব। এবারের বাজেটে আমলাতন্ত্র, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ট্রাম্প প্রশাসনই সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, বর্তমান সরকারের বাজেটে সেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটানোর কথা নেই। সম্পদ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছ থেকে গিয়ে কিছু মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হয়। এবারের বাজেটেও সেই প্রবণতা দেখা গেছে।
তিনি আরও বলেন, এবারের বাজেটে প্রতারণা ও অস্বচ্ছতার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, সেটা অব্যাহত থাকুক আমরা চাই না। আগামী ২২শে জুন বাজেট অনুমোদনের আগে এর ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে। বাজেটে জাতীয় সক্ষমতা সৃষ্টির ন্যূনতম উদ্যোগ নিতে হবে।
আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ার ড. গোলাম রসুল বলেন, সত্যিকার অর্থে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এই বাজেটে তেমন কিছু নেই। কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। কৃষিকে আমরা নানাভাবে আন্ডার ভ্যালু করে দিচ্ছি। স্বাস্থ্য খাতে এবার জনপ্রতি বাজেট বেড়েছে ২২ টাকা।