ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

বন্ধ হয়নি ওয়েবিল, টাঙানো হয়নি ভাড়ার তালিকা

নূরে আলম জিকু
১৩ আগস্ট ২০২২, শনিবার
mzamin

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। গত ৭ই আগস্ট ভাড়ার হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে নতুন ভাড়ার তালিকা টাঙানোর কথা। তবে প্রজ্ঞাপন জারির ৫ দিনেও টানানো হয়নি ভাড়ার তালিকা। এতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে আসছেন বাস মালিকরা। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। দফায় দফায় বৈঠকও করেন মালিক সমিতির নেতারা। বিআরটিএ নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় রোধে ‘ওয়েবিল’, ‘চেকিং’ পদ্ধতি বাতিলসহ ও ভাড়ার তালিকা টানানোর সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনটি। বাস স্টাফদের এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়। তবে মালিক সমিতির নেতাদের সেই নির্দেশনা মানছেন না গণপরিবহনের শ্রমিকরা।

বিজ্ঞাপন
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অন্যান্য সময়ের মতোই ওয়েবিল ও চেকিং পদ্ধতিতেই ভাড়া আদায় করছেন গণপরিহন শ্রমিকরা। বিভিন্ন স্পটে চেকাররা বাস থামিয়ে যাত্রীদের মাথা গুনছেন। ওয়েবিলে যাত্রীসংখ্যা লিখে স্বাক্ষর করছেন তারা। অধিকাংশ বাসে নেই ভাড়ার তালিকা। ফলে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে বাস চালকরা। এ নিয়ে বাসে বাসে যাত্রী ও বাস স্টাফদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা দেখা গেছে।  এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা।

 সকাল ১০টা। নতুনবাজারের উদ্দেশ্যে মালিবাগ রেলেগেট থেকে তুরাগ (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪১৬১৩) বাসে ওঠেন আব্দুল হালিম। ১৫ টাকা ভাড়াও দেন। বাসের সহকারী আরও ৫ টাকা দাবি করেন। আব্দুল হালিম ভাড়ার তালিকা দেখতে চান। বাসে তালিকা না থাকায় দুজনের মধ্যে চলে বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে শুরু হয় হাতাহাতি। পরে রামপুরা ব্রিজের বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়ে বাসটি। বাস থামিয়ে বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন। বাড়তি ভাড়া নেয়ার তথ্য প্রমাণও পান তারা। সেইসঙ্গে বাসে ভাড়ার তালিকা না থাকায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগে একই স্থানে আটকানো হয় আরও ৫টি বাস। সকাল ৯টায় রাজধানীর পোস্তগোলা থেকে যাত্রী নিয়ে রাইদা (ঢাকা মেট্রো ব ১৪৯০২৩) পরিবহনের বাসটি চৌধুরীপড়ার আবুল হোটেল সংলগ্ন স্থানে পৌঁছায়। কন্ডাক্টর চিৎকার দিয়ে বলছেন ‘সামনে ওয়েবিল। কেউ নামার থাকলে নেমে যান। পরে কিন্তু ভাড়া বাড়বে।’ মুর্হূতেই কয়েকজন যাত্রী নেমে যায়। চেকার বাসের যাত্রীগুনে ওয়েবিলে স্বাক্ষর করে নেমে যান। আব্দুল হালিম বলেন, আগে মালিবাগ রেলগেট থেকে নতুনবাজারে ১০ টাকা দিয়ে যাতায়াত করতাম। 

তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ১৫ টাকা ভাড়া দিয়েছি। এতে বাসের কন্ডাক্টর আরও ৫ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। বাসটিতে বাড়ার কোনো তালিকা নেই। পুরো পথে যাত্রী উঠিয়েছে আর নামিয়েছে। বাসে যাত্রীদের দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতিও নেই। তবুও দ্বিগুণ বাড়া আদায় করছে।  রাজধানীর মগবাজার মোড়, বাংলামোটর মোড়, খামারবাড়ি, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় ওয়েবিল প্রথা সচল থাকতে দেখা গেছে। সুমন নামের এক যাত্রী বলেন, প্রতিটি বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে। বাস শ্রমিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছেন। বাসে ভাড়ার কোনো তালিকা নেই। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। কোনো নিয়মকানুন মানছেন না তারা। ওয়েবিল বন্ধ হয়নি। জায়গায় জায়গায় চেকিং করা হচ্ছে। ওয়েবিল থাকায় দুই এক কিলোমিটার পথ যেতে গুনতে হচ্ছে ২০ টাকা। কোথাও আবার তারও বেশি।  এদিকে মিরপুর রুটে মোহনা, বসুমতি, পরীস্থান, রাজধানী, অসিম, প্রজাপতি পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহনে চেকিং দেখা না গেলেও অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। তারা বলছেন, বিআরটিএ থেকে ভাড়ার চার্ট টানানোর নির্দেশনা থাকলেও বাস মালিকরা তা মানছেন না।

 ভাড়ার তালিকা না থাকায় বাড়তি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছেন। তবে একই রুটে চলা ইতিহাস পরিবহনে চেকিং প্রথা চালু রয়েছে।  যাত্রাবাড়ী-উত্তরা-গাজীপুর রুটের বেশিরভাগ বাস অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। এসব বাসেও নেই ভাড়ার তালিকা। কোনো কোনো বাসে পুরাতন তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নতুন তালিকা দু-একটি বাসে ঝুলিয়ে রাখা হলেও সেই হারে ভাড়া নিচ্ছে না পরিবহন স্টাফরা। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করছেন তারা। এছাড়া ভাড়ার তালিকায় ৪ থেকে ৫টি স্টপেজের ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও বেশিরভাগ স্টেপেজের তালিকায় দেখা যায়নি। একই চিত্র অন্যান্য রুটেও। গাবতলী থেকে মিরপুর-১০ নম্বরে আসেন মো. আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, আগে গাবতলী থেকে মিরপুরে ২০ টাকা দিয়ে আসতাম। এখন ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে। ভাড়ার তালিকা না থাকার কারণে যাত্রীরা কিছু বলতে পারছেন না। 

যাত্রীরা বাস মালিক শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কমলাপুর থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানা রুটে যাতায়াত করছে আয়াত পরিবহন। আগে ৩টি স্পটে ওয়েবিল থাকলেও গতকাল ওয়েবিল দেখা যায়নি। তবে পরিবহনটিতে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। এছাড়া টানানো হয়নি নতুন ভাড়ার তালিকা।  আয়াত পরিবহনের এক চালক বলেন, আমরা ওয়েবিল চাইনা। এতে মালিক পক্ষের চাপ রয়েছে। তারা আমাদেরকে সব সময় চাপের মুখে রাখে। প্রতিদিন বাস প্রতি ৩ হাজার টাকা মালিকদেরকে জমা দিতে হয়। রাস্তার সব খরচ আমাদের। বাড়তি দামে তেল কিনতে হচ্ছে। সড়কে বাস নামালেই  পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমিতিসহ অন্যান্য খাতে ১ হাজার ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আমাদের পারিশ্রমিক তুলতে হয়। এজন্য আমরা সব সময় চাপে থাকি। বেশি যাত্রী তুলতে চেষ্টা করি। মালিকরাই আমাদেরকে বেশি ভাড়া নিতে বাধ্য করেন। তারা ভাড়ার তালিকা না দিলে আমাদের কী করার আছে।  এদিকে রাজধানীর সদরঘাট থেকে মিরপুরগামী প্রায় প্রতিটি বাসেই নেয়া হয়েছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কয়েকগুণ ভাড়া। এই রুটের বাসেও টানানো হয়নি ভাড়ার তালিকা। এখানেও কয়েকটি পরিবহনে এখনো ওয়েবিল প্রথা চলমান রয়েছে।  গুলিস্তান থেকে বিহঙ্গ পরিবহনে ফার্মগেট আসেন জামাল নামের এক যাত্রী। আগে ১০/১২ টাকা ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করলেও গতকাল ২০ টাকা ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, প্রেস ক্লাব এলাকায় চেকিং ও ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া নিয়েছেন বাস কন্ডাক্টর।

 একই পরিবহনের আরেক যাত্রী বলেন, প্রেস ক্লাব থেকে আগারগাঁও যেতে ৩০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। অথচ একই ভাড়া মিরপুর-১২ পর্যন্ত যাওয়া যায়। কাকরাইল থেকে সাইন্সল্যাব পর্যন্ত ফাল্‌গুনী পরিবহনে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয়েছে ১৫ টাকা। যারা শাহবাগ মোড়ে নেমেছেন তাদেরকেও একই ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে। শিকড় পরিবহনের হেলপার মেহেদী বলেন, ভাড়ার তালিকা পেয়েছি, কিন্তু এখনো টানানো হয়নি। ভাড়া চার্ট অনুযায়ীই নেয়া হচ্ছে। ইমন হোসেন নামের খাজা বাবা পরিবহনের চালক বলেন, আমরা এখন কোনো চেকার রাখি নাই। ভাড়া সরকার নির্ধারিত হারেই নেয়া হচ্ছে। তবে তালিকা এখনো টানানো হয়নি। এদিকে গত বুধবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,  ঢাকা ও এর আশপাশের শহরতলীর বাসে রাস্তায় কোনো পরিদর্শক (চেকার) থাকবে না। এক বাসস্ট্যান্ড থেকে অন্য বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। 

অর্থাৎ রুট পারমিট অনুযায়ী বাস স্ট্যান্ডের বাইরে থামিয়ে যাত্রী তোলা যাবে না। বিআরটিএ’র তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নেয়া, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করা, সব গাড়িতে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার তালিকা টাঙিয়ে রাখা হবে। এছাড়া ওয়েবিল ও চেকিং প্রথা বন্ধ থাকবে। তবে এর কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো যাত্রী হয়রানি বেড়েছে কয়েকগুণ।  এদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ঠেকাতে মাঠে বিআরটিএ’র ১০টি টিম ভ্রামমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। এতে ঢাকা মহানগরের ১০টি স্পটে ২৪টি বাসের বিপরীতে ৯২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে বিআরটিএ।  এছাড়া  রুট পরমিট বিহীন, হাইড্রলিক হর্ণ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ৯৫টি বাসের ৩ লাখ ২০ হাজার ৫শ’ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।  

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

মৌলভীবাজারে জাতীয় পার্টির সম্মেলন সম্পন্ন / ‘আমরা আওয়ামী লীগে নেই, বিএনপিতেও নেই

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status