অর্থ-বাণিজ্য
সহজ ভ্যাট ব্যবস্থাপনা-আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি চান ব্যবসায়ীরা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
(১ দিন আগে) ২৬ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৯:০০ অপরাহ্ন

বর্তমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে স্থানীয় অর্থনীতিতে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও ব্যবসায়িক হয়রানি, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চহার, আয়কর ও ভ্যাট প্রদানে জটিলতা এবং অসহনীয় যানজটের কারণে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয়বৃদ্ধির পাশাপাশি সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশানুরূপ নয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
শনিবার ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, আয়কর ও ভ্যাট, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার এবং যানজট’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এসব কথা জানান।
রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মপুর ও আদাবর অঞ্চলের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিরূপণ ও করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) টোকিও কনভেনশন সেন্টারে এ সভার আয়োজন করে। সভায় উক্ত এলাকার ১০টি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারাসহ বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্ভূত নানা চ্যালেঞ্জ, কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট, আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, যার ফলে বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমাদের এসএমইখাতের উদ্যোক্তারা।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
তাসকীন আহমেদ বলেন, ডিসিসিআইয়ের পক্ষ হতে আসন্ন বাজেটে উৎসে করের হার যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা, মূসক হার সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ ও অনানুষ্ঠানিকখাতের জন্য ১ শতাংশ হারে মূসক নির্ধারণ এবং ভ্যাট আপ চালুর প্রস্তারের পাশাপাশি সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের উন্নয়ন হবে, সেই সঙ্গে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আহরণ।
তিনি আরও বলেন, শিল্পায়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রাপ্তি প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অটোমেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গতিশীলতা আনায়ন এবং সরকারের পক্ষ থেকে যুগোপযোগী নীতি সহায়তার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কর দিতে চান, কিন্তু আমরা কোনো হয়রানি চাই না। যে কোনো স্তরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে আইনের শাসন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক (এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রাম্স ডিপার্টমেন্ট) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৭ মার্চ একটি মাস্টার সার্কুলার প্রদান করেছে, যেখানে এসএমইদের ঋণপ্রাপ্তির সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেয়াদি ঋণের সময়সীমা ৫ বছর থেকে ৭ বছরে উন্নীত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন স্কিমের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে, যেখানে এখাতের উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এ ঋণের হার মাত্র ৫ শতাংশ। তিনি উল্লেখ করেন, বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধিকল্পে ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও (সিআরআর) ৫.৫০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকার (পশ্চিম) অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিলন শেখ বলেন, সরকারের মোট রাজস্বের প্রায় ৮০ শতাংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরণ করতে হয়, যা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। তিনি জানান, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় এ বছর ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত ৩ মাসে এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভাটের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভ্যাটের আওতা এবং ভ্যাট আদায় বৃদ্ধিতে মোবাইল অ্যাপ প্রবর্তনের প্রস্তাব সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে পারে। ভ্যাটের বিষয়টিকে জটিল ভেবে দূরে না থেকে এ বিষয়ে জানার পরিধি বাড়ানোর জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
আরেক বিশেষ অতিথি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (তেঁজগাও বিভাগ) মো. আলমগীর কবির বলেন, গত দুই মাসে এ অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে, সেই সঙ্গে মামলার পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। গত ২৭ মার্চ পুলিশের ব্লক রেইডের মাধ্যমে ৬৩ জন চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সম্প্রতি শুধু মোহাম্মদপুর এলাকায় একদিনে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ৭১ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এ এলাকায় অ্যাক্টিভ পুলিশিংয়ের আওতায় ৬৩টি পেট্রলিং প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তিনি অপরাধ নির্মূলে জনগণকে তথ্য দিয়ে সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে মোহাম্মদপুরের শপিংমলগুলোতে নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে অবহিত করার জন্য এলাকাবাসী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক, তেঁজগাও জোন) তানিয়া সুলতানা যানজটের নিরসনের জনগণের সচেতনতা বাড়ানো ও ট্রাফিক আইন মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জানান, তেঁজগাও জোনে বর্তমানে ৬৩২ জন ট্রাফিক পুলিশ কর্মরত। স্বল্প জনবল দিয়ে বৃহৎ অঞ্চলে ট্রাফিক সেবা নিশ্চিতকরা বেশ কষ্টসাধ্য একটি কাজ।
মুক্ত আলোচনায় টোকিও স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সদস্য মোহাম্মদ হীরু এবং ফারুক আহমেদ, রাপা প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সভাপাতি মোতাহার হোসেন, টাউন হল বাজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি লুৎফর রহমান বাবুল, বাংলাদেশ ব্রিকস অ্যাসোসিয়েশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার বণিক সমিতির সভাপতি মো. লুৎফর রহমান (বাবুল) এবং ট্যাক্স কনসালটেন্ট প্রবীর কুমার পাল প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী এবং সহ-সভাপতি মো. সালেম সোলায়মান উপস্থিত ছিলেন।
ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা ভ্যাট প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি, ভ্যাটের অ্যাপ প্রবর্তন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, চাঁদাবাজি বন্ধ, যানজট নিরসন, ঋণের সুদের হার হ্রাস ও ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি হ্রাস প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
অনুষ্ঠান শেষে ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে ডিসিসিআইয়ের নতুন সদস্যপদ প্রদান করা হয় এবং ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির হাতে ডিসিসিআইয়ের মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন।