দেশ বিদেশ
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও মার্কিন শুল্ক
নতুন বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিনিয়োগ সম্মেলন করে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানানোর পরপরই নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে উদ্যোক্তাদের। বিনিয়োগকারীরা এতে আশাহত এবং নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে গড়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সমপ্রতি অতিরিক্ত ১০ শতাংশ যোগ হয়েছে। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও চ্যালেঞ্জে পড়েছে।
দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, নানা চ্যালেঞ্জের কারণে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক, দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে শিল্পে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে একলাফে ৭৫ টাকা করায় নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকশিত হবে না। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। বৈদেশিক আয়ও কমে যাবে। কারণ এমনিতেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি।
নিট পোশাক রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিল্প গ্যাসের দাম আগে ৩০ টাকা ছিল, সেটাই নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল। এরপর আরও দাম বাড়ালে নতুন করে শিল্প স্থাপনের আগ্রহ হারাবেন বিনিয়োগকারীরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, দাম বৃদ্ধিতে কোনো বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না। বরং বিনিয়োগকে মজবুত করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আমরা সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি করছি। আমদানির মূল্য হচ্ছে ৭০ টাকার মতো। এখন শিল্পে গ্যাসের দাম ৩০ টাকার মতো। এখন ৪০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে আপনি কতোদিন চালাবেন? জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ এখনই ২০ হাজার কোটি টাকা। এখন গ্যাসের এই বৃদ্ধির ফলে দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকার মতো। তারপরও ৩০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
সূত্র জানায়, এখন গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার এমএমসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট পার ডে) অর্থাৎ ৪০০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ এমএমসিএফডি (২৮০-২৯০ কোটি ঘনফুট)। ফলে এক হাজারেরও বেশি ঘাটতি রয়েছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি তাসকিন আহমেদ। তিনি বলেন, এমনিতেই উদ্যোক্তারা অনেক চাপে আছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এসব বিড়ম্বনা নিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোয় বিড়ম্বনা আরও বেড়ে গেল। তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা। আবার এভাবে গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে। তা হলে বিনিয়োগ বাড়বে কীভাবে?
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন কারখানা তো হবেই না, পুরনো কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশ আমদানিনির্ভর হবে। গণশুনানিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু তারা কিছুই শোনেনি।
শিল্প খাতে নতুন সংযোগের পাশাপাশি পুরনো সংযোগের ক্ষেত্রে যারা অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করবেন তাদের বেলায়ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন গ্রাহকের ক্ষেত্রে শিল্পের বয়লারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যমান যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশের বেশি লোড ব্যবহার করবেন তাদের ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন দর চলতি এপ্রিল মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। তাতেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি পাননি শিল্প মালিকরা।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ আসা শুরু হয়েছিল। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে কারখানাগুলো রুগ্ণ হয়ে যাবে। জ্বালানি ঘাটতির কারণে আমাদের এমনিতেই উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে পুরো দেশটা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হলে দাম না বৃদ্ধি করে কমানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। শিল্পকে বাঁচাতে হলে গ্যাসে দাম কমিয়ে বরং সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ দরকার।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং এসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিল্পের স্বার্থে, কর্মসংস্থানের স্বার্থে আগের বার যে ৩০০ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছিল তা কমিয়ে ২০ থেকে ২২ টাকায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন।
সমাধান: সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, গ্যাস-বিদ্যুতের একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। হুটহাট করে দাম না বাড়িয়ে যদি একটা দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান থাকে যে, এক বছর পর ৫ বা ১০ শতাংশ বাড়ানো হবে। এভাবে দুই বছর পর কতো, ৫ বছর পর কতো বাড়ানো হবে, সেটি যদি আগে থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হতো তা হলে উদ্যোক্তারা সে অনুযায়ী তাদের ব্যবসার প্ল্যান ঠিক করতে পারতেন। সেটি না করে হুটহাটভাবে কখনো গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে, আবার কখনো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে করে শিল্প উদ্যোক্তাদের চরম বিপাকে পড়তে হয়।
এ ছাড়া দাম বৃদ্ধি না করে কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লস কমিয়ে আনা গেলেই খরচ অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব। গ্যাস চুরি বন্ধ না করে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে কারখানা মালিকদের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক, অবাস্তব।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ। উৎপাদন নিরুৎসাহিত হবে। কমবে কর্মসংস্থান। তিনি বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশে বিনিয়োগে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় খরচ বেশি। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে চায় না। দেশি বিনিয়োগকারীদেরও নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম। এ অবস্থা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এরপর বিনিয়োগসংক্রান্ত উপকরণের দাম বাড়ানো হলে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও কমবে। ফলে অর্থনীতির স্বার্থে বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ মার্কিন প্রতিনিধিদলের: বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত শুল্ক সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছে ঢাকায় সফররত দেশটির প্রতিনিধিদল। আগামী ৯ই জুলাই ওই শুল্ক আদেশের ওপর ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ শেষ হওয়ার আগেই এটি করার কথা বলেছেন তারা। মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল অ্যান চুলিক ও অ্যান্ড্রু হেরাপের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে এ পরামর্শ দেয়। শুক্রবার এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।