দেশ বিদেশ
পোড়া রোগীদের আশা জাগছে স্কিন ব্যাংকে
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
১৪ মার্চ ২০২৫, শুক্রবার
দগ্ধ রোগীদের প্রাণে বেঁচে থাকার স্বপ্ন জাগাচ্ছে স্কিন ব্যাংক। রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে দেশের প্রথম ‘স্কিন ব্যাংক’-এর যাত্রা শুরু হয় সমপ্রতি। ইতিমধ্যে যাদের শরীরে চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এখানে দাতাদের ত্বক বা চামড়া সংগ্রহ করে দগ্ধ রোগীদের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি চালুর পর এখন পর্যন্ত ১০ জন রোগীকে চামড়া দেয়া হয়েছে। এই পর্যন্ত স্কিন ব্যাংকে ১০ হাজার বর্গ সেন্টিমিটার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা বলছেন, আট বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বার্ন ইনস্টিটিউট বিশ্বমানের। কিন্তু স্কিন ব্যাংক না থাকায় ত্বক প্রতিস্থাপন করা যেত না। শরীরের ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেলে তাকে ‘মেজর বার্ন’ বলা হয়। এ ধরনের রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো হলে ত্বক প্রতিস্থাপন করা যায়। যদি আমরা স্কিন দিতে পারি তাহলে ওই রোগীর বেঁচে থাকার সুযোগ বাড়ে। এভাবে মৃত্যুর সংখ্যা কিছু কমবে। কারও শরীর পুড়ে গেলে রক্তনালিগুলো উন্মুক্ত হয়ে যায়। অ্যালবুমিন, ইলেকট্রোলাইটসহ সব ধরনের ফ্লুইড বের হয়ে যায়। এতে রোগী সেপটিসেমিয়া, এলডিএসের দিকে চলে যায়। তার মৃত্যুও হতে পারে।
এ বিষয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, গুরুতর দগ্ধ হলে শরীর থেকে পানি, লবণ, প্রোটিন ও তাপ দ্রুত বেরিয়ে যায়। যদি পোড়ার পরিমাণ বেশি হয় এবং রোগীর শরীর থেকে চামড়া নেয়া সম্ভব না হয়, তখন স্কিন ব্যাংক থেকে সংরক্ষিত চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমে এবং দ্রুত নতুন চামড়া তৈরি হতে সহায়তা করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কিন ব্যাংক একটি স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতে এটি দীর্ঘদিন ধরে চালু রয়েছে।
স্কিন ব্যাংকের কো-অর্ডিনেটর ডা. মাহবুব হাসান জানান, সুস্থ ব্যক্তি জীবদ্দশায় একাধিকবার চামড়া দান করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অবশ করা হয়। বিশেষ ডার্মাটম যন্ত্রের সাহায্যে শরীরের সুবিধামতো স্থান থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। দাতার হাসপাতালে ভর্তি থাকার প্রয়োজন নেই, ১৪ দিনের মধ্যেই শরীরে নতুন চামড়া তৈরি হয়ে যায়। মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব, যদি লাশ সংরক্ষিত থাকে। সাধারণত পিঠ ও পা থেকে চামড়া সংগ্রহ করা হয়।
স্কিন ব্যাংকের ইনচার্জ তামান্না সুলতানা বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটের ১২৩৯ নম্বর কক্ষে স্কিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। এখানে উন্নত প্রযুক্তির ৮টি বিশেষ ফ্রিজের মাধ্যমে সংরক্ষণ প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফোয়ারা তাসমীম মানবজমিনকে বলেন, এখন কিছু চামড়া নিচ্ছি রোগীর আত্মীয়স্বজন থেকে। যারা দিচ্ছেন তাদের ডোনার কার্ড দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে তারাও স্কিন ব্যাংক থেকে চামড়া নিতে পারবেন। তিনি জানান, কিছু জটিলতা আছে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। বার্ন ইনস্টিটিউটে স্কিন ব্যাংকের যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডভিশনের বিক্রয় কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, তারাই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এই মেশিন সরবরাহ করেছেন। এগুলো আমেরিকার উৎপাদিত যন্ত্রপাতি। দেশে চিকিৎসাসেবায় গত ৪০ বছর সুনামের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সাপোর্ট দিয়ে আসছে তাদের প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে স্কিন ব্যাংকের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হলে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা অনেক সহজ হবে। পর্যাপ্ত দাতার অংশগ্রহণ থাকলে এটি দগ্ধ রোগীদের সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমপ্রতি দুই বছরের শিশু হামিদার শরীরের ৩৫২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার চামড়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। শিশুটির মা রাবেয়া বেগম জানান, গত ২২শে ডিসেম্বর গরম পানিতে পুড়ে শরীরের ৪২ শতাংশ দগ্ধ হয়। চিকিৎসকরা স্কিন ব্যাংক থেকে সংগৃহীত চামড়া প্রতিস্থাপন করলে ধীরে ধীরে শিশুটির শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। ৮ বছর বয়সী আরেক শিশু মরিয়মের শরীরের ৭৭৯ সেন্টিমিটার পোড়া অংশ ঢেকে দেয়া হয়েছে স্কিন ব্যাংকের সংরক্ষিত চামড়া দিয়ে। তার মা মজেমা বেগম জানান, গ্যাসের চুলার আগুনে পুড়ে শরীরের ২২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চিকিৎসকরা চামড়া প্রতিস্থাপনের পর শিশুটির অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
চলতি বছরের গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এই স্কিন ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তবে ইতিমধ্যে ১০ রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাদের শারীরিক অবস্থার উন্নতিও লক্ষ্য করা গেছে।
স্কিন ব্যাংকের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দাতার কাছ থেকে ত্বক সংগ্রহ করেন প্লাস্টিক সার্জনরা। সেটি বিশেষ পাত্রে করে নিয়ে আসা হয় স্কিন ব্যাংকে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে বায়োসেফটি কেবিনেটে রেখে ত্বকের রক্ত ও চর্বি পরিষ্কার করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘রিইনজিং’। পরিষ্কার করার পর ত্বক একটি অ্যান্টিবায়োটিক সল্যুশনের মধ্যে ডুবিয়ে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফ্রিজে রাখা হয়। এ অবস্থায় রাখা হয় তিন থেকে চারদিন। এই সময়ের মধ্যে ওই ত্বকের ‘কালচার’ করা হয়, দেখা হয় তাতে কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্য কিছু আছে কিনা। কোনো ক্ষতিকারক উপাদান না থাকলে তা তরল নাইট্রোজেনে ডুবিয়ে মাইনাস ৯০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফ্রিজারে রাখা হয়। রাখা যায় পাঁচ বছর পর্যন্ত।
কোনো রোগীর শরীরে ত্বক প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে ওই ব্যাংক থেকে নেয়া হয়। সে সময়ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত বিশেষ একটি পাত্রে ত্বক বহন করা হয়। স্কিন ব্যাংকের সমন্বয়ক এবং বার্ন ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব হাসান বলেন, স্কিন ব্যাংকের জন্য এখনো মরণোত্তর ত্বক নেয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন অস্ত্রোপচার করার জন্য কেটে ফেলা ত্বক এখন ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১০ হাজার বর্গ সেন্টিমিটার চামড়া সংগ্রহ হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন মানবজমিনকে বলেন, একজন মানুষ মারা যাওয়ার ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া সংগ্রহ করতে হয়। এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রয়োজন।