দেশ বিদেশ
জাতীয় নাগরিক কমিটির সংলাপ
পররাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো রয়ে গেছে
কূটনৈতিক রিপোর্টার
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবারআওয়ামী জামানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই নতজানু এমন মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক কমিটির সংলাপে বক্তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। বিশেষ করে বাংলাদেশের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের ফোকাল পয়েন্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মিশনগুলোকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করা। কিন্তু ৬ মাসেও পররাষ্ট্র ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়নি। সেখানে এখনো অনেক দোসর রয়ে গেছে। সত্যিকারের সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়তে এখনই জনবান্ধব পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের দাবি রেখে বক্তারা বলেন- এখন সময় এসেছে চিরায়ত সম্পর্ক থাকা দেশগুলোর বাইরেও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নতুন বাজার খোঁজার। তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ও দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গড়তে হবে। ডানপন্থিদের উত্থান ও জঙ্গিবাদের প্রোপাগান্ডার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও জোর দিতে হবে।
রাজধানীর ইস্কাটনস্থ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে মঙ্গলবার দিনব্যাপী ওই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ‘গণ-অভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি: নতুন দিগন্তের সন্ধানে’ শীর্ষক সংলাপের প্রথম সেশনের বিষয় ছিল ‘গণ-অভ্যুত্থান উত্তর পররাষ্ট্রনীতির গতিমুখ’। এতে অন্যতম আলোচক ছিলেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন। তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক সরকার যখন থাকে, তখন তাদের ক্ষমতার উৎস হয় রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বাইরের শক্তি, যা গত ১৬ বছর ছিল। পররাষ্ট্রনীতি ছিল নতজানু। তিনি বলেন, বিএনপি সব সময় সমতার ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলেছে। মাহদী আমিন আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বড় প্রত্যাশা ছিল, ফ্যাসিবাদের দোসরদের না রাখা। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি যারা দেখছেন, সেখানে এখনো অনেক ফ্যাসিবাদের দোসর রয়ে গেছেন। আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ভারত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং চারদিক দিয়ে পরিবেষ্টিত। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলে অশান্তি হয়। ভারত চাইবেই বাংলাদেশকে হাতের মুঠোয় নিতে। কারণ, এর সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। আর শুধু ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব দেশই নিজের স্বার্থ দেখে। বাংলাদেশ শুধু নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিল।
তিনি বলেন, ভারত ও চীন এ অঞ্চলে অত্যন্ত প্রভাবশালী। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দক্ষতার সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি মোকাবিলা করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা সার্কভুক্ত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন। এখানে কাজ করা প্রয়োজন। ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখা জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান এ এস এম আলী আশরাফ। পররাষ্ট্রনীতিতে অর্থনৈতিক বিষয়ে জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেখতে হবে, কাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বেশি।
রাতারাতি এই বাণিজ্য অংশীদার পরিবর্তন করা যাবে না। এদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে বাজার আরও বিস্তৃত করায় মনোযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, নিজেদের স্বার্থেই প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের যেভাবে নিজেকে মুখপাত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, সেই অবস্থানও ধরে রাখতে হবে। এ এস এম আলী আশরাফ বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানামুখী প্রোপাগান্ডা চলছে। বলা হচ্ছে এখানে উগ্রবাদ নাকি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সে ক্ষেত্রে এটা খুব সাবধানে দেখতে হবে। উগ্রবাদ নিয়ে বাইরে আদতে কোনো উদ্বেগ আছে কিনা? সে বিষয়গুলো পররাষ্ট্রনীতিতে বিবেচনায় আনতে হবে। শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশে কোনো পররাষ্ট্রনীতিই ছিল না উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ-উর রহমান বলেন, পরিবর্তিত সময়ে পররাষ্ট্রনীতিতে সার্বভৌম বাংলাদেশের নীতি কী হবে, সে বার্তা দিতে হবে। বিশ্বে এখন অশান্ত পরিস্থিতি চলছে, চারদিকে ডানপন্থিদের উত্থান। বাংলাদেশেও যদি সে ধরনের কিছু হয়, তবে সেটা ধর্মপন্থি হবে। সেটা হলে আগামীর দিন চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ, ৫ই আগস্টের পরের কিছু ঘটনায় সে রকম মনে হতে পারে যে দেশের ক্ষমতা ডানপন্থিদের হাতে চলে গেল কিনা। যেটাকে ভারত প্রচারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বমানচিত্রে প্রভাব রাখা এবং সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় কতোটা নেতৃত্ব দিতে পারবে, সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে। সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ বসানো যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ শুধু দিয়েছে। বাহাত্তরে একটি দেশের কাছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিক্রি করে দেয়া হয়। একটি দেশের সেবাদাস হিসেবে থেকেছে। সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানো যায়নি। নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী আরও বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে সারা দিন স্লোগান দিয়ে কাজ হবে না, বরং ফ্যাক্ট (তথ্য) নিয়ে কথা বলতে হবে। ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিতে হলে বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি থাকতে হবে। এই প্রজন্মকে চব্বিশের অর্জন টেনে নিয়ে এগোতে হবে, নয়তো মানুষ অভিশাপ দেবে। সংলাপে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনৈতিক সম্পাদক আলাউদ্দীন মোহাম্মদ। প্রথম সেশন সঞ্চালনা করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য মনিরা শারমিন।