দেশ বিদেশ
বিডিআর বিদ্রোহ
সেদিন যেভাবে বেঁচে যান মেজর ইকবাল
রাশিম মোল্লা
২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার২০০৯ সালে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দু’টি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা, অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা। হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট বিভাগে রায় হলেও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি এখনো রয়েছে সাক্ষী পর্যায়ে। এখন পর্যন্ত ২৮৩ জন সাক্ষী দিয়েছেন। গতকাল সাক্ষী দিয়েছেন মেজর (অব.) সৈয়দ মো. ইউছুফ ইকবাল। তিনি আদালতের কাছে বিডিআর বিদ্রোহের নানা ঘটনা ও নিজের বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন। এ বিষয়ে স্পেশাল প্রসিকিউটর সরকার মো. নূরে এরশাদ সিদ্দিকী মানবজমিনকে বলেন, মেজর (অব.) সৈয়দ মো. ইউছুফ ইকবাল আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। সেদিনের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা আদালতের কাছে তুলে ধরেছেন।
আদালতে সাক্ষী প্রদানকালে ইউছুফ ইকবাল বলেন, আমি মেজর সৈয়দ মো. ইউছুফ ইকবাল। রাইফেলস সপ্তাহ/২০০৯ উপলক্ষে ১৬ই ফেব্রুয়ারি সিগন্যালস, রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড স্কুল থেকে ঢাকার বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় আসি। ৩রা ফেব্রুয়ারি আমার ছোট ভাই শহীদ মেজর সৈয়দ মো. ইদ্রিস ইকবাল তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্যারেডে পতাকাবাহী কন্টিনজেন্টের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় যোগদান করে। আমার দায়িত্ব ছিল ভিআইপিগণের দাওয়াত কার্ড পৌঁছে দেয়া এবং আমার ছোট ভাই শহীদ সৈয়দ মো. ইদ্রিস ইকবালের দায়িত্ব ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্যারেডে পতাকাধারী কন্টিনজেন্টের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। ২৪শে ফেব্রুয়ারি আমার ছোট ভাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্যারেডে পতাকাবাহী কন্টিনজেন্টের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে আমি নিজে পিলখানায় উপস্থিত ছিলাম। পিলখানার সদর দপ্তরে কর্মরত জিএসও-১ (অপস ও গোয়েন্দা) শহীদ লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টায় আমাকে অফিসে আসতে বলেন এবং ২৬ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানে কোন কোন ভিআইপি অংশগ্রহণ করবেন তা নিশ্চিত করার বিষয়ে অফিসে বসে দায়িত্ব পালন করতে বলেন। আমি সামান্য সময়ের জন্য পিলখানার বাহিরে যেতে চাইলে তিনি পরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন বলে জানান। আমি তখন পিলখানায় জিএসও-২ গোয়েন্দা হিসেবে কর্মরত শহীদ মেজর মাহমুদুল হাসানের অফিসে টেলিফোনের মাধ্যমে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে থাকি। ২৫শে ফেব্রুয়ারি আনুমানিক সকাল সাড়ে ৯টায় আমার ছোট ভাই শহীদ মেজর সৈয়দ মো. ইদ্রিস তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে আমাকে জানায় দরবার হলে গোলাগুলি হচ্ছে। আমি তাকে বিস্তারিত জানাতে বলি এবং আরও বলি আমিও ব্যাপারটা জেনে তোকে জানাচ্ছি। সে মোবাইল ফোনে আমাকে জানায় ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে বিডিআর সদস্য গুলি করেছে। তার অবস্থান জিজ্ঞাসা করলে জানায় সে দরবার হলেই আছে। তখন তাকে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে বলি এবং আল্লাহ্কে ডাকতে বলি। ঘটনাটি শুনে আমি দ্রুত অফিসের বারান্দায় এসে দেখতে পাই বিডিআরের পোশাক পরিহিত সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে এবং ছোটাছুটি করছে। তখন আমি আমার ভাইয়ের ব্যক্তিগত মোবাইন ফোনে ফোন করি। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি। তখন আমি দরবার হলে উপস্থিত লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সাহেবকে ফোন করে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে গুলি হচ্ছে, তুমি অফিস এলাকায় অবস্থান করো। চারদিক থেকে সৈনিকদের ছোটাছুটি ও গুলির আওয়াজ আরও বেশি করে আসতে থাকে, তখন আমি নিচতলায় উপস্থিত সদস্যদের অফিসের বাহিরে না গিয়ে আমার সঙ্গে থাকার জন্য বলি। তারাও আমার সঙ্গে থাকে। গুলির তীব্রতা আরও বাড়তে থাকলে আমি একই অফিস বিডিংয়ের দোতলায় চলে যাই। সেখানে উপস্থিত বিডিআর সদস্যদেরকে (সহকারী বা ক্লার্ক) বাহিরে না যাওয়ার জন্য বলি। তখন গোলাগুলি এত বেশি হচ্ছিল যে, সমস্ত অফিসের সদস্যদেরকে নিয়ে একটি রুমের ফ্লোরে শুয়ে পড়ি এবং আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা আমার র্যাঙ্ক ব্যাজ খুলে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পাই, একদল বিডিআর সদস্য গুলি করতে করতে অফিসের দিকে ছুটে আসছে। তখন উপস্থিত বিডিআর সদস্যরা অফিস থেকে চলে যায়। আমাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে এবং তখন উপায়ন্তর না দেখে আমি উক্ত অফিসে রক্ষিত কম্পিউটার টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ি। আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে মহিলাদের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ শুনতে পাই। আমার মোবাইলের মাধ্যমে এসএমএস দিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে আমার ভাই ইদ্রিস ইকবালের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। কারণ তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আমি যে রুমের টেবিলের নিচে ছিলাম তার বিপরীত পার্শ্বে থাকা যোগাযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক শহীদ কর্নেল মশিউর রহমান এবং লে. কর্নেল সৈয়দ কামরুজ্জামান সাহেবের অফিস ছিল। সেখানে তিন থেকে চার গ্রুপ বিদ্রোহী বিডিআর সদস্য এসে গুলি ও গালাগালি দিতে থাকে। আমার রুমে এসে কম্পিউটারে গুলি করতে চাইলে অপর সদস্য বাধা দেয় এবং বলে কম্পিউটার থাক। এখন থেকে তো আমরা বিডিআর চালাবো বলে রুম ত্যাগ করে। আমি টেবিলের নিচে ২৫শে ফেব্রুয়ারি আনুমানিক ১০টা থেকে ৭টা পর্যন্ত অবস্থান করি। পানির পিপাসা, খাদ্য এবং টয়লেট না করতে পারায় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ি। বিকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে মনে হলো কোনো সদস্য অফিসের রুম বন্ধ করছে। তখন আমি যেহেতু অসুস্থ তাই আল্লাহ্র নাম নিয়ে তাকে দেখেই ডাকলাম। সে কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, স্যার আপনি বেঁচে আছেন? আমি বলি আল্লাহ্ রক্ষাকর্তা তাই বেঁচে আছি। সে আরও বলে যে স্যার আপনি আমাকে কীভাবে ডাকলেন। আমি যদি ওদের কেউ হতাম? উত্তরে বলি, আমি তোমাদের সঙ্গে ১৫ মিনিট কাজ করে বুঝতে পেরেছি তুমি ভালো। উপরন্ত আমার সঙ্গে তোমার কোনো শত্রুতা নেই। তখন সে আমাকে বাথরুম থেকে পানি এনে খাওয়ায়। আমার পোশাক সে নিজে পড়ে এবং তার নিজের পোশাক আমাকে দেয়। উক্ত বিডিআর সদস্যর নাম ল্যান্স নায়েক সহকারী কামাল। তিনি বিপথগামী সদস্যদের ব্যাপারে তিরস্কার করে এবং বলে আমি ক্লার্ক, কাজেই আমি জানি ডাল-ভাত বা অন্য কোনো রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি করত কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা হয়। যেখান থেকে ব্যক্তিগতভাবে কোনো টাকা নিতে পারে না এবং আরও বলে “স্যার আমাকে যদি এখন কর্মকর্তার কাজ করতে বলে তবে আমি করতে পারবো না, কারণ আমি তো উক্ত পণ্যের যোগ্য নই। সে আরও বলে, “স্যার আপনি বেঁচে থাকলে পরবর্তীতে আমাকে বাঁচাবেন, আমি গরিব মানুষ”।
২৫শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর আমি তাকে অফিস রুমের (যেখানে আমি ছিলাম) তালা বন্ধ করে চলে যেতে বলি এবং আমার ভাইয়ের চেহারা ও পোশাকের বর্ণনা দিয়ে তাকে অনুরোধ করি তার খোঁজ নিয়ে আমাকে যেন জানায়। সে কিছুক্ষণ পর এসে জানায় তাকে কোয়ার্টার গার্ডের (যেখানে জিম্মিরা ছিল) এবং দরবার হলের আশপাশে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা যেতে দিচ্ছে না। দূর থেকে কোয়ার্টার গার্ডে কিছু অফিসারকে জিম্মি দেখে আমাকে জানায় ইনশাআল্লাহ্ আপনার ভাই জীবিত আছেন বলে সান্ত্বনা দেয়। আমি ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম। বারবার তাকে আমার ছোট ভাই মেজর ইদ্রিস ইকবালকে খোঁজ করতে পাঠাই। ২৬শে ফেব্রুয়ারি উক্ত ল্যান্স নায়েক সহকারী কামাল ভোর আনুমানিক সাড়ে ৫টায় তালা খুলে আমার রুমে আসে এবং তাদের মেসে দেয়া খিচুড়ি ও বিস্কুট এনে আমাকে খেতে দেয়। তখন তাকে আবার দরজা বন্ধ করে চলে যেতে বলি। পরিস্থিতি সম্বন্ধে সে বলে, “স্যার কিছুই বুঝতে পারছি না, কেউ মাইকে বলে অস্ত্র জমা করো, কেউ বলে দরকার নেই, আর্মি আসবে ইত্যাদি ইত্যাদি”। উক্ত রুমে অবস্থানকালীন সময়ে ২৫শে ফেব্রুয়ারি মাগরিবের সময় মাইকে শুনতে পাই এখন আর্মিরা অ্যাটাক করতে পারে। সবাই প্রস্তুত থাকবে, রাতে কেউ ঘুমাবে না। আবার ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফজরের নামাজের সময় একই কথা শুনতে পাই। এখন আর্মি অ্যাটাক করতে পারে, সবাই প্রস্তুত থাকুন বলে। বিডিআরের সৈনিক জান দেবো শুধু তবু মান দেব না ইত্যাদি ইত্যাদি। দুপুর অনুমান ৩টায় ল্যান্স নায়েক কামাল আরও কয়েকজন বিডিআর সদস্য আমাকে বেসামরিক পোশাক এনে দিয়ে পরতে বলে এবং জানায় কোয়ার্টার গার্ড থেকে জিম্মিদের ছেড়ে দিচ্ছে, আপনাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে পিকআপ গাড়িতে উঠায়ে দিব, আপনি চলে যাবেন। তখন আমি তাদের দেয়া পোশাক পরে ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটের দিকে পিকআপ গাড়িতে উঠে পিলখানার বাহিরে আসি।