অনলাইন
শতরঞ্জির শহরে
সিরাজুস সালেকিন চৌধুরী
(১ বছর আগে) ১ মে ২০২২, রবিবার, ১:৪৮ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৩:০৮ অপরাহ্ন

যদি প্রশ্ন করা হয়- রংপুরের ঐতিহ্য কী? ভিন্ন অঞ্চলের কেউ হলে বলবেন বিড়ি শিল্প। কেউ হয়তো বলবেন হাড়িভাঙ্গা আম। কিন্তু শত বছরের ঐতিহ্যবাহী যে শিল্প গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে তা খোদ রংপুরের স্থানীয় অনেকেরই অজানা। আর তা হচ্ছে শতরঞ্জি। ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর ঘর সাজানোর এই উপকরণ সম্প্রতি বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শতরঞ্জি বলতে সাধারণত মেঝেতে বিছানোর কার্পেট বা
গালিচাকে বোঝায়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই পণ্যে বৈচিত্র্য এসেছে। ফ্লোরম্যাট ছাড়াও ওয়ালম্যাট, টেবিল ম্যাট, মানিব্যাগ, পাপোশ, জায়নামাজ, ঘরের মেঝের কার্পেট, স্কুলব্যাগ, পার্টস, মোবাইল ব্যাগ ইত্যাদি পণ্য তৈরি করছেন এর কারিগররা। তুর্কি ও ইরানি কার্পেটের থেকে শতরঞ্জি দিন দিন জনপ্রিয় হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। শতরঞ্জি ডিজাইন হাতে বুনা হয় যার ফলে দুই পাশ থেকে ডিজাইন বা নকশা সমানভাবে লক্ষণীয় এবং এর কোনো উল্টো-সোজা নেই।
শতরঞ্জি শব্দের অর্থ শত রঙের বাহার। আবার কারও কারও মতে সতের রঙের সুতা ব্যবহারের কারণে এর নাম শতরঞ্জি। ত্র্রয়োদশ শতাব্দীতেও রংপুর এলাকায় শতরঞ্জির প্রচলন ছিল। মোঘল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো বলে ইতিহাসে কথিত রয়েছে। সম্রাট আকবরের সভাকক্ষে এবং বৃটেনের রাজদরবারেও তা শোভাবর্ধন করতো। তাই শতরঞ্জি পণ্যের একটা ঐতিহ্য বা ঐতিহাসিক ভিত্তি হচ্ছে আভিজাত্য।

অতীতে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ঘরে এই শিল্প পণ্যটি দেখা যেতো না। জমিদার পরিবারে শতরঞ্জি সামাজিক মর্যাদা ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলোবাড়ি, খাজাঞ্চিখানা, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বসার স্থান, শয়নকক্ষ কিংবা বৈঠকখানায় সতের রঙের সুতায় বোনা শতরঞ্জিকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আভিজাত্যের এই বর্ণনা পাওয়া যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রী দেবতা’ উপন্যাসে। এখানে বর্ণিত রয়েছে যে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে শতরঞ্জি ‘সোনার কৌটায় ডোমরা’ হিসেবে সমাদৃত। রাজা-বাদশাদের প্রাসাদে এর ব্যাপক কদর ছিল। ১৯১২ সালে প্রকাশিত রংপুর গেজেটিয়ারে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টার উল্লেখ করেন, ১৮৩০ সালে রংপুর জেলা কালেক্টর মি. নিশবেত এ অঞ্চলে শতরঞ্জি নির্মাণ শৈলী দেখে মুগ্ধ হন এবং এ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার সহায়তায় রংপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠে এ বয়ন শিল্প। তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ গ্রামের নাম রাখা হয় নিশবেতগঞ্জ। স্থানীয় তথ্যমতে, এখানে বড় আকারের রং-বেরঙের গালিচা বা শতরঞ্জি তৈরি হতো। পিলপারা বা হাতির পা নামে এক প্রকার শতরঞ্জি ছিল যা শুধু রংপুরেই তৈরি হতো। ১৯১৩ সালে রংপুরের তদানীন্তন ডেপুটি কালেক্টর তার রংপুর বিবরণী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, রংপুর শহরের উপকণ্ঠে নিশবেতগঞ্জ গ্রামে পাঁচ শতাধিক লোক শতরঞ্জি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বৃটিশ শাসনামলে শতরঞ্জি এতবেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, সে সময় নিশবেতগঞ্জের শতরঞ্জি রপ্তানি হতো ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
এখানে বংশ পরম্পরায় শত শত শ্রমিক, কারিগর ও পরিবার শতরঞ্জি তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন। পূর্বে রংপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প শতরঞ্জি শুধুমাত্র বিশেষ কয়েকটি গ্রামে তৈরি হতো। বর্তমানে পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে এ শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটেছে। শতরঞ্জি নিয়ে আশার কথা হচ্ছে, এক সময়কার মৃতপ্রায় এই শিল্প এখন পুনঃরুজ্জীবিত। নিশবেতগঞ্জে গড়ে ওঠা শতরঞ্জি পাড়ার শতরঞ্জির বর্তমান যে অবস্থা তা কখনোই সমান্তরালভাবে এগিয়ে যায়নি। বিভিন্ন সময়ে শতরঞ্জি শিল্পের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়েছে। নিকট অতীতে শতরঞ্জি শিল্পে বড় ওলোটপালট হয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। এই সময়ে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পের প্রসারে উদ্যোগ নেয় এবং অন্যান্য সরকারি উদ্যোগের মতো তা ভেস্তে যায়। বিসিকের উদ্যোগ বন্ধ হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতরঞ্জি শিল্পের পুনরুত্থান শুরু হয়। শতরঞ্জিপাড়ার বাইরে রংপুর সদর থানার ভাইরকাটারী, পায়রাবন্দ, মাহিগঞ্জ, তাজহাট, বখতিয়ারপুর, বানিয়া পাড়া গ্রামগুলোতেও শতরঞ্জি তৈরি হয়। কিন্তু এই গ্রামগুলোতে শতরঞ্জির বিস্তার ঘটে শতরঞ্জি পাড়া থেকেই। বিভিন্ন এনজিও বিভিন্ন সময়ে এইসব গ্রামের মানুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে শতরঞ্জি তৈরি করতে শেখায়। পরবর্তীতে এই গ্রামগুলোতে তারা কারখানা বসিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শতরঞ্জি উৎপাদন শুরু করে। কারও কারও তথ্যমতে, শতরঞ্জিপাড়ায় বর্তমানে ৮০/৯০টি পরিবার শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার কারও মতে তা একশ’র উপরে। তবে এটা নিশ্চিত যে খুব কমসংখ্যক পরিবার বাদ দিয়ে এই গ্রামের সবাই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নিশবেতগঞ্জ শতরঞ্জিপাড়ায় বর্তমানে শতরঞ্জি তৈরি হয় কটন ও মখমল সুতা দিয়ে। তবে কোনো কোনো গ্রামে পাট দিয়ে শতরঞ্জি তৈরি হতে দেখা যায়। পাকিস্তান আমলে বগুড়ার সুতাকল থেকে কটন সুতা এনে তা দিয়ে শতরঞ্জি তৈরি করা হতো। বগুড়া ও নওগাঁর মাঝামাঝি শাওয়াইল হাট থেকে শতরঞ্জি তৈরির ‘মগ’ সুতা আসে রংপুরের শতরঞ্জি পাড়ায়। আর কটন সুতা পাওয়া যায় রংপুরেই। মখমল সুতা ‘বানায়’ ব্যবহার করা হয়। কটন সুতা দিয়ে টানা দেয়া হয়। বর্তমানে পাটের সুতাও ব্যবহার হচ্ছে শতরঞ্জি তৈরিতে।
আরেক মাধ্যমে জানা যায়, ১৭৩৬ সালে রংপুরের পীরজাদাপুর, রাধাকৃষ্ণপুর, দামোদরপুরে শতরঞ্জি তৈরি শুরু হয়। শৈল্পিক কারুকার্য খচিত শতরঞ্জি দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় হওয়ায় এর কদর ক্রমেই বাড়তে থাকে। বর্তমানে রংপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় এবং বিভিন্ন জেলাতেও গড়ে উঠছে শতরঞ্জি কারখানা। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে ঘাঘট নদীর তীরে কয়েকটি গ্রামে এই শতরঞ্জির উৎপাদন হয়। ভৌগোলিক আবহাওয়াজনিত কারণে রংপুরের ঘাঘট নদীর পানি শতরঞ্জি সুতার রঙের উপযোগী, যেমন উপযোগী জামদানির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর পানি। যতদূর জানা যায়, রংপুরের আবহাওয়া ও জলবায়ু তথ্য প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণেই রংপুরে শতরঞ্জি শিল্পের কারুশিল্প গড়ে উঠেছে শত শত বছর পূর্বে। রংপুরে রবার্টসন এলাকায় ‘কারুপণ্য রংপুর লি.’ এর উদ্যোগে শতরঞ্জি উৎপাদন হচ্ছে। প্রায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক ও কারিগর এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এছাড়া নিশবেতগঞ্জ ও রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামে সরকারের উদ্যোগে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। নিশবেতগঞ্জে নতুন উদ্যমে বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি। নিশবেতগঞ্জের শতরঞ্জি পল্লী এবং রবার্টসনগঞ্জ এলাকার ‘কারুপণ্য রংপুর লি.’ মিলে বৃহৎ পরিসরে শতরঞ্জি কারুপল্লী স্থাপিত হয়েছে। চাহিদা বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘আইকা’ ও ‘বিবি রাসেল’ এর উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। সময়কে ধারণ করে আপন বৈশিষ্ট্যকে আরও উজ্জ্বল করতে নিশবেতগঞ্জ থেকে মোংলাকাটি গ্রামেও পাড়ি জমিয়েছে শতরঞ্জি শিল্প। উল্লেখ্য- প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্প সামগ্রী রপ্তানি করা হয় তার ৫০ ভাগই শতরঞ্জি। বছরে আয় হচ্ছে লাখ লাখ মার্কিন ডলার। এই কৃতিত্বের দাবিদার রংপুর অঞ্চলের প্রায় পাঁচ হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, যাদের ৯০ শতাংশ নারী কর্মী। এই কারুপণ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২০ থেকে ২২ হাজার মানুষের জীবন। কালের আবর্তে এদেশে অনেক কারুশিল্প হারিয়ে গেলেও ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি শিল্প স্বকীয়তা নিয়ে আজও টিকে আছে।
বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি সবচেয়ে প্রাচীনতম। এ পণ্য উৎপাদনে যান্ত্রিক কোনো কৌশলের ব্যবহার নেই। কেবলমাত্র বাঁশের রশি দিয়ে মাটির উপর সুতা দিয়ে টানা প্রস্তুত করে প্রতিটি সুতা গণনা করে হাত দিয়ে নকশা করে শতরঞ্জি তৈরি হয়। বর্তমানে তাঁতী ও কারিগররা বিভিন্ন রঙে ও ঢঙে শতরঞ্জি বুনন করে যাচ্ছেন। শতরঞ্জি তৈরির প্রধান উপকরণ সুতা। রংপুরের ঘাঘট নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার জলবায়ু এবং ঘাঘট নদীর পানি শতরঞ্জি বুননের উপযোগী। বিশ্বের অন্য কোথাও এ শতরঞ্জি বুনন হয় না। ঘাঘট নদীর পানির সঙ্গে রং মিশিয়ে কটন সুতা ও পাটের সুতা রং করা হয়, যার ফলে সৌন্দর্য, উজ্জ্বলতা এবং রং এর স্থায়ীত্ব অনেক বেশি থাকে। শিল্পীর নিপুণ হাতে ও নিজস্ব কল্পনা থেকে বিভিন্ন ডিজাইনে তৈরি হয় শতরঞ্জি। স্থানীয় বাজার থেকে পাটের সুতলি, কটন সুতা ও উলেন জাতীয় বিভিন্ন ধরনের ফাইবার কিনে প্রয়োজন মতো রং করে শুকিয়ে নেয়া হয়। শতরঞ্জি তৈরিতে সুতা রং করা উৎপাদন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। শতরঞ্জির শৈল্পিক সৌন্দর্য ও চাহিদা বৃদ্ধিতে সুতার রং এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে সুতা রংকরণ প্রক্রিয়া শুধুমাত্র পাটের সুতার বেলায় প্রয়োগ করা হয়। কেননা বিভিন্ন রঙের সুতি ও মখমল সুতা বাজারে পাওয়া যায়। অবশ্য রং পছন্দ না হলে কিংবা নকশার প্রয়োজনে হরেক রঙের সুতা তৈরিতে নিজেরাই রঙ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। এতদিন ভেষজ রঙ বেশি ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে রাসায়নিক রঙ বেশি ব্যবহার করা হয়। ৬ থেকে ৯টি রঙের শতাধিক ডিজাইনের শতরঞ্জি বাজারে পাওয়া যায়। রঙ-বেরঙের সুতায় প্রকৃতি নির্ভর গ্রামীণ নকশায়, কারুশিল্পীদের সুনিপুণ হাতে তৈরি হয় শতরঞ্জি। অতিসাধারণ উপাদানে কারুশিল্পীদের মনের মাধুরী মেশানো রঙের বহুবিধ ব্যবহার ও কারুকাজের সমন্বয়ে শতরঞ্জি শিল্প প্রস্ফূটিত। শতরঞ্জির সৌন্দর্যের প্রধান সোপান হলো বিভিন্ন রঙের সুতা ও কারুশিল্পীদের সুতার বুনন কৌশল। শুকনো সুতা টানা দেওয়া হয় বাঁশের ফ্রেমে। টানার দৈর্ঘ্য সাধারণত দশ থেকে পয়ত্রিশ ফুট হয়ে থাকে। সুতা চরকায় বসানো হয় বান্ডিল তৈরি করার জন্য। শতরঞ্জি তাঁতে বা মেঝেতে বিছিয়ে নকশা অনুযায়ী সুতলির সাহায্যে হাতে বোনা হয়। হাতের কৌশলই শতরঞ্জি নির্মাণের ভিত্তি। তবে সুতার গাঁথুনি শক্ত করার জন্য পাঞ্জা ব্যবহার করা হয়। এভাবে শতরঞ্জি তৈরিতে নিয়োজিত প্রতিজন শ্রমিকের এক বর্গফুট শতরঞ্জি প্রস্তুতের জন্য সময় লাগে এক থেকে তিন ঘণ্টা। শতরঞ্জির আকৃতির বিষয় নির্ভর করে ক্রেতার চাহিদার উপর। এর শৈল্পিক সৌন্দর্য উল্লেখ করার মতো। এর কোনো উল্টো-সোজা নেই, দুদিকেই ব্যবহার করা যায়। শতরঞ্জি তৈরির এ প্রক্রিয়া সাধারণত আলো-বাতাস সহজে প্রবেশ করতে পারে এমন অর্ধাবৃত ঘরে হয়ে থাকে। কেবল বাঁশ ও রশি দিয়ে সুতার টানা তৈরি করে প্রতিটি সুতার জ্যামিতিক মাপে গণনার মাধ্যমে হাত দিয়ে প্রস্তুত করা হয় শতরঞ্জি।
শতরঞ্জি তৈরিতে প্রয়োজন অনুযায়ী এক বা একাধিক কারিগর কাজ করে থাকেন। ভিন্ন ভিন্ন নকশার শতরঞ্জি তৈরির জন্য সুতা চরকা থেকে খোলার পর শতরঞ্জি তৈরির টানা শুরু করা হয়। বাঁশ, রশি, পাঞ্জা, কঞ্চি, ফিতা ইত্যাদি শতরঞ্জি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শতরঞ্জির ধরন বা সাইজ, নকশা অনুযায়ী বিভিন্ন রঙের সুতা ব্যবহার করে শতরঞ্জি তৈরি হয়। তৈরি শেষে শতরঞ্জির প্রাপ্তদ্বয় থেকে বাঁশকে ছাড়িয়ে নেয়ার পর দুই প্রান্তে সুতা মুড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর কাঁচি দিয়ে সুতা কেটে শতরঞ্জিটি হালকা রোদে শুকানো হয়। এরপর ব্রাশ ও বান্ডিল করে শোরুমে অথবা গ্রাহকের কাছে বাজারজাত করা হয়। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে হরেক রকম ডিজাইন অনুযায়ী কারিগররা নানা রঙের নকশা ও বৈচিত্র্যে ভরে তোলে শতরঞ্জি। তাতে টানার সুতা লম্বালম্বিভাবে এবং ডিজাইনের ক্ষেত্রে মখমল সুতা আড়াআড়ি ভাবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামীণ কারুশিল্পীরা কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই কেবল মাত্র নিজস্ব মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বংশ পরম্পরায় তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের শতরঞ্জি।
শতরঞ্জির অন্তর্নিহীত সৌন্দর্যই হচ্ছে এর ডিজাইন বা নকশা। প্রচলিত আছে রংপুরে বিভিন্ন এলাকায় ১৭ রকমের রঙের সুতা দিয়ে হরেক রকমের ডিজাইন অনুযায়ী কারিগররা নানা ধরনের নকশা ও বৈচিত্র্যে ভরে তোলে শতরঞ্জি। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা ধরনের বাহারি নকশা শতরঞ্জি শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রাচীন নকশাগুলোর মধ্যে হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই, রাজা-রাণী, দেব-দেবী, প্রজাপতি, ঘুড়ি, নারীর মুখ, রাখাল বালক, কলসী কাঁখে রমণী, বাঘবন্ধি, পালকি, মোড়া ফুল, জামরুল পাতা, রথ পাড়ি, দাবারঘর, লাইট, পৌরাণিক চরিত্র, নবান্ন, পৌষপার্বণ, গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি শিল্পীর নিপুণতায় শতরঞ্জির নকশা হিসেবে এসেছে। শতরঞ্জি তৈরিতে সাধারণতঃ দুই ধরনের মোটিভ নকশায় ব্যবহার করা হয়। একটি প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী নকশা এবং অপরটি আধুনিক নকশা। অভিজ্ঞ অনেক শতরঞ্জি বুনন শিল্পী মৃত্যুবরণ করায় এবং অনেকে এ শিল্পচর্চা ছেড়ে দেয়ায় বুননশিল্পীরা প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী নকশার পরিবর্তে বর্তমানে আধুনিক মোটিফের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। আধুনিক মোটিভে আছে উর্বরতা ও প্রবৃদ্ধির প্রতীক, পুষ্পিতপাতা, পানপাতা, ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনার স্বাক্ষর স্বরূপ কাবাঘর, মসজিদ-মিনার ইত্যাদি। এছাড়াও জীবন-জীবিকার প্রতীক মাছ, পাখি, নৌকা, গ্রামের দৃশ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির চিত্র বুননশিল্পীরা শতরঞ্জি বুননের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। পরিবর্তনের ধারায় বর্তমানে জামদানি ও বালুচুড়ি শাড়ির নকশার মতো বুটিদার জরি ও তেরছি নকশাও স্থান পাচ্ছে। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ীও শতরঞ্জির নকশা করা হয়। নকশায় লাল, কালো বা নীল রঙের প্রাধান্য দেয়া হয়। আধুনিক নকশার ক্ষেত্রে বিবি রাসেলের উদ্ভাবিত নকশাও উল্লেখযোগ্য।
রংপুরের শতরঞ্জি পণ্যের উৎপাদন উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। অবাধ বাণিজ্য ও তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে রংপুরের শতরঞ্জি বর্তমানে বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। শতরঞ্জি রপ্তানি থেকে এখন প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৪০ লাখ ডলার আয় করে থাকে। কালের আবর্তে অনেক কারুশিল্প হারিয়ে গেলেও শতরঞ্জি শিল্প বহুকাল থেকে আপন ঐতিহ্য নিয়ে শুধু টিকে আছে তাই নয়, বর্তমানে এর নকশা ও নান্দনিকতা এবং আধুনিকতার কারণে এই শিল্পটির ভবিষৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে।