প্রথম পাতা
শারীরিক সম্পর্কের ফাঁদে ব্ল্যাকমেইল
শুভ্র দেব
২৭ জুলাই ২০২২, বুধবার
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় আব্দুল আহাদ (২২) নামের এক যুবকের। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক ও সখ্য। মেসেঞ্জারে দুজন নিয়মিত চ্যাট করতেন। একসময় সম্পর্ক গভীর হওয়াতে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। আহাদ তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। এরইমধ্যে ওই শিক্ষার্থীর জিমেইল আইডিতে সমস্যা দেখা দেয়। তাই তিনি আইডির পাসওয়ার্ড আহাদকে দিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য অনুরোধ করেন। কিছুদিন পর আহাদের কথাবার্তায় ভিন্নতা দেখতে পান। আহাদ তাকে বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানিমূলক মেসেজ দিতে থাকে। মেসেজে তাকে শরীরের গোপন অঙ্গের ছবি ও ভিডিও তুলে তাকে দেয়ার কথা বলে। পাশাপাশি শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শিক্ষার্থীর জিমেইল আইডি দিয়ে তার ফেসবুকে প্রবেশ করে অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এ ছাড়া মানসিকভাবেও হয়রানি করছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে ওই শিক্ষার্থী আহাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার শরীরের গোপন অঙ্গের ছবি ও ভিডিও দেন। কিন্তু এসব পেয়েও থেমে থাকেনি আহাদ। তারপর সে শারীরিক সম্পর্কের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তার প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে আহাদ শিক্ষার্থীর আইডি থেকে তার গোপন ছবি ও ভিডিও আপলোড করে দেয়। আহাদের নিজের আইডি থেকেও অনেক বান্ধবী ও পরিচিতদের নগ্ন ছবি ভিডিও শেয়ার করে।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, আমি কখনো ভাবতে পারিনি আহাদ আমার সঙ্গে এরকম করবে। কথাবার্তায় তাকে অনেক ভদ্র ও ভালো মনে হয়েছিল। মেয়েদেরকে পটানোর মতো সব কৌশলই তার কাছে আছে। ভেবেছিলাম বন্ধুত্ব করবো কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল আমার জিমেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড তাকে দেয়া। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে ছবি ও ভিডিও নিয়ে যায়। ধারণা ছিল এসব নিয়ে থেমে যাবে। কিন্তু শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হওয়াতে সবকিছু ছড়িয়ে দিয়ে আমার মান সম্মানহানি করেছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবী ও পরিবারের কাছে আমি ছোট হয়ে গেলাম। উপায়ান্তর না পেয়ে আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাহায্য নেই। তাদের পরামর্শে লালবাগ থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করি। পরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ আহাদকে গ্রেপ্তার করে।
ডিবি সাইবার সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত আসামি কৌশলে বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে ফেসবুকে সম্পর্ক তৈরি করে। পরে ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলার সময় স্ক্রিন রেকর্ডারের মাধ্যমে ভিডিও ধারণ করে নেয়। পরে ওই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রস্তাব দিতো। ভুক্তভোগীরা তার কথায় রাজি না হলে আহাদ সেই মেয়ের ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। পাশাপাশি তার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তারপরও যদি মেয়েরা রাজি না হয় তাহলে মেয়ে ও তার বাবা-মায়ের মোবাইল নম্বর বিভিন্ন গোপন (১৮+) গ্রুপে শেয়ার করে দিতো। গ্রুপের মধ্যে মেয়েদের সম্পর্কে খারাপ ইঙ্গিত দিয়ে কিছু লিখে দিয়ে ফোন করার কথা বলতো।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ভুক্তভোগী মেয়েটির জিমেইল আইডি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গুগল ফটো থেকে তার আরও ব্যক্তিগত ছবি সংগ্রহ করে। এ ছাড়া আগেই মেয়েটির কাছ থেকে তার আরও কিছু গোপন অঙ্গের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেছিল। এসব দিয়ে মেয়েটিকে আহাদ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। পরে লালবাগ থানায় মামলার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে আহাদকে গ্রেপ্তার করি। তার কাছ থেকে ১টি মোবাইল ও ২টি সিম উদ্ধার করি। তার মোবাইলে মেয়েটির গোপন ছবি পাওয়া যায়। ফেসবুক আইডিও লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। এসএসসি পাস আব্দুল আহাদ মূলত একজন দোকান কর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছিল। তার মোবাইলে আরও অনেক মেয়েদের গোপন ভিডিও ও ছবি পাওয়া গেছে।
এদিকে, বিভিন্ন নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলতো সাদ্দাম হোসেন ওরফে রিজভী নামের এক যুবক। এরপর ওই ভুয়া আইডি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ ছবি ভিডিও ও বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দিতো। যদি কেউ তার প্রস্তাবে রাজি হতেন তাহলে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে বিভিন্ন আপত্তিকর টাইপ টেক্সট/ছবি শেয়ার করতো। পরে ওই ব্যক্তিকে মেসেঞ্জারের চ্যাটিং ফাঁস করে দেয়ার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিতো। কেউ একবার টাকা দিলেও তার কাছে পুনরায় টাকা চাইতো। এভাবে শত শত মানুষকে ফাঁদে ফেলার পর গ্রেপ্তার হয়েছে সাদ্দাম হোসেন। বনানী থানায় দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্তে নেমে গত সোমবার চট্টগ্রামের খুলশী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে ভুয়া নামে পাঁচটি ফেসবুক আইডি পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ জানান, এই প্রতারক বিভিন্ন নামে-বেনামে ফেসবুক আইডি খুলে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে বেশ কিছুদিন ধরে অশ্লীল ছবি ও বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর ও কু-রুচিপূর্ণ কন্টেন্ট পাঠায়। ভুক্তভোগী ব্যক্তি তাকে বিভিন্নভাবে নিষেধ করার পরেও গ্রেপ্তার রিজভী অনবরত অশ্লীল ছবি ও বিভিন্ন বাজে কন্টেন্ট পাঠাচ্ছিল। যার প্রেক্ষিতে তিনি থানায় মামলা করেন। গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারকের মোবাইল ও ফেসবুক মেসেঞ্জারের চ্যাটিং হিস্ট্রি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই সাইবার প্রতারক শত শত লোকের সঙ্গে ভুয়া আইডি দিয়ে আপত্তিকর চ্যাটিং করেছে ও বিভিন্ন কৌশলে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সাদ্দাম হোসেন ওরফে রিজভীর সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।