দেশ বিদেশ
বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরাম
ঢাকায় স্টেকহোল্ডারদের মিলনমেলা, প্রাণবন্ত আলোচনা
কূটনৈতিক রিপোর্টার
১১ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার
বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরাম-২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ক্লাইমেট অ্যাকশনের সঙ্গে যুক্ত বৈশ্বিক স্টেকহোল্ডারদের মিলনমেলা বসেছিল। দিনভর ওই আয়োজনে যুক্তি-পাল্টাযুক্তি, তর্ক-বিতর্ক তথা প্রাণবন্ত আলোচনা হয়েছে। টার্গেট ছিল বাংলাদেশের সাসটেইনিবিলিটি বা টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ খোঁজা। আয়োজকরা চেষ্টা করেছেন সংলাপ, সহযোগিতা এবং কার্যকরী কৌশলসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করতে। বর্ণাঢ্য ওই আয়োজনে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৪৫০ জন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের মুখ্য আয়োজক ছিল বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ। উদ্দেশ্য শিল্পের নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনজীবী, উদ্ভাবক, ব্র্যান্ড, উন্নয়ন সংস্থা, নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষাবিদদের একত্রিত করা। প্ল্যাটফরম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরাম। দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে ছিল মূল বক্তব্য উপস্থাপন, প্যানেল আলোচনা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞগণের মতামত প্রদান এবং কর্মশালা। যেখানে প্রায় ৪০ জন দেশি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যেখানে তারা সহযোগিতা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে একটি জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক এবং কার্বন-নিরপেক্ষ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার বিষয়ে তাদের মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন। তাছাড়া এ ফোরামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরাম ২০২৪ আয়োজনে সহযোগী হিসেবে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জিআইজেড, এইচঅ্যান্ডএম, ঢাকাস্থ ডাচ্ দূতাবাস, অ্যাপারেল ইমপ্যাক্ট ইনস্টিটিউট, ক্যাসকেল, পিডিএস লিমিটেড এবং টার্গেট। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। যার মধ্যে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম. ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত এইচ-ই মাইকেল মিলার, জার্মান রাষ্ট্রদূত অখিম ট্রোস্টার, ডাচ্ দূতাবাসের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স থিজ ওয়াউডস্ট্রা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ইমপ্রেসিভি বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, যেকোনো উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, কোথায় কীভাবে পণ্যটি উৎপাদন হচ্ছে? সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদনই মুখ্য বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব ঝুঁকি তৈরি করেছে সর্বক্ষেত্রে এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। এটিকে কেবলমাত্র কমপ্লায়েন্স ইস্যু হিসেবে বিবেচনা না করে সঠিক ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া উচিত বলে মনে করেন উপদেষ্টা পদমর্যাদায় সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নীতি কৌশল বাস্তবায়নে নিয়োজিত লুৎফে সিদ্দিকী। আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম. ফাওজুল কবির খান বলেন, আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ কম, যা প্রায় ২ শতাংশ। আমরা এটিকে আরও বৃদ্ধি করতে চাই। আমরা সাসটেইনিবিলিটিতে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বৃহত্তর সিস্টেমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা সাসটেইনিবিলিটির দিকে অগ্রযাত্রায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রতিটি ভগ্নাংশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সকলের একটি সামষ্টিক দায়িত্ব রয়েছে। অনুদান এবং ছাড়যোগ্য ঋণ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে ৩০০ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ একত্রিত করার গ্লোবাল গেটওয়ের লক্ষ্য রয়েছে। জার্মানির রাষ্ট্রদূত অচিম ট্রস্টার বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা বাংলাদেশ এবং জার্মানি উভয়ের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই, নিরাপদ এবং স্থিতিস্থাপক উপায়ে তার জ্বালানি চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। ডাচ্ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স বলেন, আমি সত্যিই আনন্দিত যে, পোশাক শিল্প ডিকার্বনাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে টেকসই এবং সার্কুলার টেক্সটাইলকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে জ্ঞান ভাগাভাগির কাজটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি বাংলাদেশের পোশাক খাত এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, আপনি পৃথিবীর প্রতি যত্নবান, আপনি দেশের প্রতি যত্নবান এবং এই কারণেই আপনি আজ এখানে আছেন। আপনারা সবাই আমার অনুপ্রেরণা। ক্লাইমেট অ্যাকশন কোনো বোঝা নয় বরং উদ্যোক্তাদের জন্য এটি একটি ব্যবসায়িক সুযোগ। আমি এভাবেই ভাবি। আপনারা সবাই বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এবং এদেশ থেকে দারিদ্র্য ও দুর্যোগ দূর করতে চান। সস্তা শ্রম বাংলাদেশের জন্য এখন আর প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নয়। উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা যদি আমাদের ক্রেতাদের কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জন না করি, তাহলে আমরা সফল হতে পারবো না। লক্ষ্য অর্জনের জন্য, উৎপাদনকারীদের আরও সামষ্টিক দায়িত্ব নিতে হবে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমর্থন প্রয়োজন। আয়োজকরা জানান, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিপিএমআই), বাংলাদেশে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ও সুইডেন দূতাবাস, আইএলও, লডস ফাউন্ডেশন, অক্সফাম বাংলাদেশ, এবং ইউএসএআইডি বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরাম ’২৪ এ যুক্ত ছিলেন। তাছাড়া বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান আর্মস্ট্রং ফ্লুইড টেকনোলজি, ফোর্বস মার্শাল, গ্রান্ট থর্নটন ভারত এলএলপি, ইলুকুম্বুরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন (প্রাইভেট) লিমিটেড এবং জিনকো সোলারের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় আয়োজন করা হয় ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’। পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে ৩০০ এর অধিক প্রকৌশলী এ ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাসটেইনেবিলিটি এবং ডিকার্বনাইজেশন বাস্তবায়নে ব্যবহারিক জ্ঞান ও কৌশলসমূহ আয়ত্ত করার সুযোগ লাভ করেন। স্মরণ করা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন, নেতৃত্ব, সহযোগিতা এবং সকলের জন্য একটি টেকসই, কম কার্বন ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি স্থাপন করা বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যাকশন ফোরামের অন্যতম লক্ষ্য।