দেশ বিদেশ
যশোরে স্বল্প পরিসরে কাজে যোগ দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা
স্টাফ রিপোর্টার, যশোর থেকে
১২ আগস্ট ২০২৪, সোমবারযশোরে স্বল্প পরিসরে কাজে যোগ দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। রোববার সকাল থেকে বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেন। তবে এসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা নিজেদের এবং সরকারি সম্পত্তি ও অস্ত্র গোলাবারুদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় প্রকাশ করেন। তবে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক ছাত্র-জনতাকে মাঠে থেকে পুলিশ প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে স্বল্প পরিসরে পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরলেও তারা সবাই ছিলেন সাদা পোশাকে।
জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার দুর্বার গণআন্দোলন এবং ৫ই আগস্ট মহাবিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটে। এই গণআন্দোলন প্রতিহত করতে সরকারের নির্দেশে দেশব্যাপী পুলিশ নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। ফলে বহু ছাত্র-জনতা হতাহতের ঘটনা ঘটে। জনবিক্ষোভে বহু পুলিশ সদস্যও হতাহতের শিকার হন। দেশের প্রায় সকল বিভাগ ও জেলায় পুলিশ ছাত্র-জনতা মুখোমুখি অবস্থানের ফলে জনরোষের শিকার হন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছর ধরে সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি এবং সরকারি দলের নেতাদের তলপিবাহকে পরিণত হওয়া পুলিশ সদস্যরা গণধিকৃত হতে শুরু করে। যার ফলে খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, মাগুরা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়াসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলসহ সারা দেশের শত শত থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি এবং পুলিশ ক্যাম্প জনরোষের শিকার হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করে অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ সদস্যদের মারপিট করে। কোনো কোনো থানার অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র গোলাবারুদ লুট করার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু যশোরে। এই দীর্ঘ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যশোরের পুলিশ প্রশাসন চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেননি। কোনো কোনো সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশে বিশেষ করে পুলিশ সদস্যরা ছাত্র-জনতার মুখোমুখি হননি। যার কারণে ৫ই আগস্ট বিজয়ের পর সারা দেশে থানা পুলিশ আক্রান্ত হলেও যশোরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বরং ছাত্র-জনতা মানবঢাল তৈরি করে পুলিশ সদস্য ও থানা এবং সকল সরকারি সম্পত্তি ও অফিস আদালতকে রক্ষা করেছেন। একইসঙ্গে ৫ই আগস্টের পর যশোর জেলা বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিজয় পরবর্তী সহিংসতা রোধ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে মাঠে নামেন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাসহ সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষায় নিরাপত্তা বিধানে তাদের কর্মী সমর্থকদের পালাক্রমে ডিউটির কাজে নিয়োজিত করেন। একইসঙ্গে ৭ই আগস্ট জেলা প্রশাসক আবরাউল হাসান মজুমদার তার সভাকক্ষে সর্বদলীয় সভা করে জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা ও উন্নয়নে করণীয় শীর্ষক দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর পুলিশ প্রশাসনকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যশোরের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজে ফেরার আহ্বান জানান। সরকারি ভাবেও পুলিশ সদস্যদের দ্রুত কাজে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শকও বার বার বার্তা দিয়ে পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগদানের নির্দেশনা প্রদান করেন। তারপরও যশোরে পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরছিলেন না। সর্বশেষ গত শনিবার বিকালে যশোর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক যৌথ সভা করেন পুলিশ সুপার মাসুদ আলম। সেখানে অবিলম্বে মানুষের জানমাল রক্ষায় এবং জেলা ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে পুলিশ সদস্যদের মাঠে নেমে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। একপর্যায়ে যশোরের সকল থানার অফিসার ইনচার্জ, ফাঁড়ির ইনচার্জ, ক্যাম্পের ইনচার্জসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা এসপিকে আশ্বস্ত করেন যে, রোববার সকাল থেকে তারা কাজে ফিরবেন। পুলিশ সুপার কাজে ফেরা সকল পুলিশ সদস্য এবং তাদের সরকারি স্থাপনা ও অস্ত্র গোলাবারুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশ^াস দেন। সেই কথার প্রেক্ষিতে রোববার সকাল থেকে জেলার ৯টি থানা, ৩টি পুলিশ ফাঁড়ি ও ৩০টি ক্যাম্পে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরতে শুরু করেন। তবে এসব পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কাজে যোগদানকারী পুলিশ অফিসার ও সাধারণ কনস্টেবলরা পুলিশের বর্তমান পোশাক আর গায়ে জড়িয়ে জনরোষের শিকার হতে চাচ্ছেন না। গতকাল সকালে যশোর পুলিশ লাইন্সের মেইন গেটে পুলিশ সদস্যরা তাদের ১১ দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানিয়ে ব্যানার টাঙিয়ে দেন। এই ১১ দফার অন্যতম দাবি হচ্ছে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন, দুর্নীতিবাজ, সরকারি অর্থ লুটপাটকারী ও ক্ষমতার অব্যবহারকারী পুলিশ অফিসারদের বিচার দাবি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ৪ জন ইন্সপেক্টর, ১০ জন সাব-ইন্সপেক্টর ও ২০ জন এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টরসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ১শ’ পুলিশ সদস্য কর্মরত আছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার সময় এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত ২ জন ইন্সপেক্টর, ৮ জন সাব-ইন্সপেক্টর ও ১০ জন এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টরসহ ৩৫ জন পুলিশ সদস্য কাজে ফিরেছেন। যশোর ট্রাফিক বিভাগের ৩ জন ইন্সপেক্টরসহ প্রায় শতাধিক সদস্য কর্মরত থাকলেও গতকাল বিকাল পর্যন্ত অফিসে ফিরেছেন ২৭ জন। কিন্তু তারা অফিস করলেও মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন শুরু করেননি। যশোর ডিবি পুলিশের অফিসার ইনচার্জ রূপণ কুমার সরকার জানান, আমি সব সময় অফিস করছি। আমার অফিসে ৩ জন ইন্সপেক্টর, ১৮ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১৩ জন এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টরসহ মোট ৬০ জন কর্মরত আছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলমান অবস্থায় বা ৫ই আগস্টে সরকারের পদত্যাগের পরও তার কোনো ছাপ যশোর ডিবি অফিসে পড়েনি। আমরা সব সময় কাজ করছি। তবে আগের মতো এখনো বাইরে অভিযান পরিচালনার মতো অবস্থায় আমরা ফিরতে পারিনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, আমরা পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু যশোরে পুলিশের ওপর কোনো সহিংসতা বা কোনো সরকারি সম্পদ বা গোলাবারুদের ওপর কোনো আঘাত আসেনি। তাই আমরা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে ছিলাম। বর্তমানে সারা দেশের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আমাদের জেলায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরাও কিছুটা শঙ্কিত, আতঙ্কিত ছিল। আমাদের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ যশোরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা যশোর পুলিশে কর্মরত সকল পর্যায়ের সদস্যদের মনোবল বৃদ্ধি করে তাদেরকে কাজে ফেরানোর চেষ্টা করছি। আজ থেকে সীমিত পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে। মনে করছি ২/১ দিনের মধ্যে পুলিশ প্রশাসনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে যশোরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, আমি যশোরের ছাত্র-জনতাকে বার বার ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে তা অবিশ^াস্য। লাখো মানুষের মিছিলে মিছিলে যখন যশোর প্রকম্পিত হচ্ছিল তখনো আমার পুলিশ সদস্যরা ছাত্র-জনতার পাশে থেকে সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা এবং সরকারি সম্পত্তি ও অফিস আদালত রক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ৫ই আগস্ট সরকার পরিবর্তনের আগে পরে দেশের অন্য জেলায় পুলিশের ওপর যেভাবে হামলা, মারপিট, পুলিশ সদস্যদের হত্যা, অস্ত্রাগার লুট, থানায় থানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে তার দৃশ্য দেশে যশোরের পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। তারা তাদের এসোসিয়েশনের ডাকে সাড়া দিয়ে কর্মবিরতি পালন শুরু করে। থানা, পুলিশ ফাঁড়ি ও ক্যাম্পগুলো এক প্রকারে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তারপরও আজ পর্যন্ত যশোরের পুলিশ বিভাগের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতা বা কোনো মিসক্রিয়েন্ট গ্রুপের পক্ষ থেকে কোনো অশুভ দৃষ্টি পড়েনি। তার একটায় কারণ হচ্ছে জেলা পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সকলে মিলে পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবলকে চাঙ্গা করতে একসঙ্গে কাজ করছি। ইতিমধ্যে আইজিপি স্যারের নির্দেশে পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সদস্য কাজে যোগ দিয়েছেন। ইনশাল্লাহ অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকিরাও কাজে যোগ দিবে। জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারাও রাস্তায় নামলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।