ঢাকা, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ২২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস

রাজপথে শিক্ষার্থী শিক্ষক, শিল্পী নাগরিক সমাজ

স্টাফ রিপোর্টার
২ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবারmzamin

কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে এবার রাজপথে নেমেছেন শিক্ষক, নাগরিক সমাজ, আইনজীবী ও শিল্পীরা। গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা,  আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং শিক্ষার্থী হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এসব কর্মসূচি থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশব্যাপী পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেন শিক্ষকরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচিও পালিত হয় গতকাল। এর মধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় ১২ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের তুলে নেয়ার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মানববন্ধনে আসতে বাধা দেন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়াও সারা দেশে আটক শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দিতে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ ব্যানারে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। সমাবেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও একই দাবিতে এর আগে সকাল ১০টায় লোক প্রশাসন ও ১১টায় অর্থনীতি বিভাগ আলাদা ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।

এসময় শিক্ষার্থীদের ওপর যারা গুলি চালিয়েছে তাদের বিচার না করে উল্টো শিক্ষার্থীদের আটক করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। দেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন গোটা জাতির মুক্তির আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এসময় সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, চট্টগ্রামে শিক্ষকদের বাসার সামনে বোমা ফেলা হয়েছে। শিক্ষকদের নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সরকার ভুলে গিয়েছে এখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, জনতা বলতে আলাদা কিছু নেই। বাংলাদেশের সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সরকার যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণই জয়লাভ করবে। একটি ছেলেকেও জেলে রেখে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম করা যাবে না। যেভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাতে একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি করেছে সরকার। দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ নেই, গাজা, ইউক্রেনে পরিণত হয়েছে। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে সরকার, নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশরেকা অদিতি হক বলেন, আমাদেরও এই আন্দোলনে আর হারানোর কিছু নাই। কিন্তু অনেক কিছু পাওয়ার আছে। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোবরাতুল দীপা বলেন, ভয় যেমন সংক্রামক, সাহসও তেমনি সংক্রামক। বুকে সাহস নিয়ে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে হবে। একটি খুনি সরকারের কাছে আমি বিচার চাই না, কারণ সে নিজেই খুনি।  

এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাইকা বশির বলেন, এটা কোনো স্বাধীন দেশ? এটা যদি স্বাধীন দেশ হয় তাহলে এমন স্বাধীন দেশ আমি চাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, আমাদের শিক্ষকদের বাড়ির সামনে ককটেল নিক্ষেপ, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান করবো এমন কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসুন। নয়তো আপনাদেরই সরে যেতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থী হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে হবে, প্রতিটি মানুষের রক্তের হিসাব নিতে হবে। এখন এই আন্দোলন জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির আন্দোলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, এভাবে দেশের মানুষকে অন্যায়ভাবে গুম, খুন জেলে ভরা আর চলবে না। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারছে না। আমি শিক্ষক, আমাকে পুলিশকে আইডি কার্ড দেখাতে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী উপাচার্যের কর্তৃত্বে চলে নাকি পুলিশ কনস্টেবলের কর্তৃত্বে চলে? আমরা শিক্ষাঙ্গন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যাহার চাই। শিক্ষার্থী হত্যার বিচার ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই।
এরপর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে যান। সেখান থেকে মৌন মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে যান। এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান নিহতদের প্রতি। 

নাগরিক সমাজের ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম: ঢাকাসহ সারা দেশে আটক সকল শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের ছেড়ে দিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ। বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে ডিএমপি’র গোয়েন্দা কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানান বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

অর্থনীতিবিদ ও জননীতি বিশ্লেষক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে আটক ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ বিনা বিচারে আটক ও আইনানুগ ব্যবস্থা ছাড়া আটকদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এটা হচ্ছে আমাদের প্রধান দাবি। আমরা শুনেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে আমরা খুশি, কিন্তু সন্তুষ্ট নই। কারণ এখনো ঢাকাসহ সারা দেশে আটক ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষ বিনা বিচারে আটক আছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যেভাবে নিরপরাধ মানুষ মারা গেছে সকলের বিচার করতে হবে। সেই বিচারের জন্য জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হবে। স্কুল-কলেজ খুলে দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেখান থেকে সরাতে হবে। ইন্টারনেটের অবাধ সেবা দিতে হবে। আপনারা বলেছেন, এই ঘটনার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এটা আমি বিশ্বাস করি না। ভাবমূর্তি যদি নষ্ট হয় সেটা সরকারের হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বন্দুক, গুলি কেনা হয়েছে। সেই বন্দুক দিয়ে আমার দেশের মানুষকে মারা হবে, এজন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। এটা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য না। অন্যায়-অত্যাচার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধুমাত্র এই ৬ জন আটকের বিষয় নয়, সার্বিকভাবে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এই সংস্থাগুলো, তার পেছনে মূল বিষয় হলো দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা হয়েছে। সেই ধারণা হচ্ছে-তারা বিচারহীনতা উপভোগ করতে পারবে চিরদিন। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কেন মিথ্যা কথা বলছেন। বন্ধ করুন মিথ্যা কথা। আপনি বলুন-আমি নির্বিচারে গুলি করেছি। ছাত্রদের হত্যা করেছি। এই মিথ্যাচার নির্ভর সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ দেশবাসী জেনে গেছে, এটা মিথ্যাচারের কারাগার। সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিটা বিষয়ে জনগণকে মুর্খ মনে করেছে, অথচ নিজেরা যে মুর্খতার পরিচয় দিয়েছে সেটা তারা ভুলে গেছে। এই মুর্খতা, অন্ধত্ব এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে তারা যে কাজগুলো করেছে সেটা সম্পূর্ণভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে, আইনের লঙ্ঘন করেছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে উদ্দেশ্য করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে পেশাগত উৎকর্ষের কথা তারা বলে থাকেন, যে প্রশিক্ষণ তারা পেয়েছেন সেগুলোকে পদদলিত করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে তাদের মানদণ্ডে দেশবাসীকে বিচার করার কেনো সুযোগ নেই। দেশবাসী তাদের মতো মুর্খ নয়। তারা যে মিথ্যাচার করেছে, মুর্খতা দেখিয়েছে সেটা দেশবাসী বুঝে গেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয়ার সমালোচনা করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আপনাদের কে বললো যে আপনাদের কাছে তারা নিরাপদবোধ করবে? নিরাপত্তার সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েন, আমরা সংবিধানে দেখবো হেফাজতের আইনে কী কী আছে। তিনি বলেন, আমরা আসার আগে তাদের (সমন্বয়কদের) ছেড়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি। তারা তাদের পরিবারের কাছে গেছে কিনা, তা এখনো জানি না। ছেড়ে দেয়া মানে কিন্তু শুধু পরিবারের কাছে আবদ্ধ নয়। তারা যে কাজটি করেছে, তাতে কোনো অন্যায় নেই। তারা যেন মুক্তভাবে তাদের কাজটি করতে পারে আমরা সে নিশ্চয়তা চাই। আপনারা কোন ক্ষমতাবলে আটকে রাখলেন? সংবিধানের কোথায় এই ক্ষমতা আপনাকে দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত প্রথার চিরতরে অবসান হতে হবে। 

আপনারা আমাদেরকে দাস মনে করেন? যখন ইচ্ছা বাসা থেকে তুলে আনবেন। যতদিন ইচ্ছা আটকে রাখবেন। তখন আমাদের নুডুল্‌স, পোলাও, ডিম খাওয়াবেন। কার টাকায় খাওয়ান এগুলো? আমাদের টাকায় তো খাওয়ান? আমাদের এগুলো খাওয়ার দরকার নাই। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি পুলিশ চাই না। আমরা বাংলাদেশের পুলিশ চাই। আপনার (পুলিশ) জনগণের জন্য কাজ করবেন। বাংলাদেশের পুলিশ হবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের সকল শিক্ষার্থীকে যদি ছেড়ে দেয়া না হয়, যদি হত্যার বিচার করা না হয়, যদি অবিলম্বে শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়া না হয় তাহলে আমাদের বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আরও কঠোর ও অব্যাহত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিন সমন্বয়ককে জোর করে ডিবি অফিসে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনসহ যারা এই কাজটি করেছে তাদের প্রত্যেকেই অপহরণ মামলার আসামি। 

নারী নেত্রী শিরীন হক বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাউকে ধরে আনা কোনো দেশের আইনে আছে? এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং আমরা এটার বিচার চাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মির্জা তাসলিমা সুলতানা বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী কারাগারে। আটকে রাখা সকল শিক্ষার্থীকে মুক্তি দিতে হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, আমার প্রশ্ন, আমরা কী কোনো জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি? যদি না থাকি তাহলে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, সভা-সমাবেশের অধিকার, বাক?-স্বাধীনতার অধিকার-এগুলো কেন নিশ্চিত করা হচ্ছে না এবং রাস্তায় কেন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে? কী এমন ঘটেছে যে জরুরি অবস্থার মতো পরিবেশ বাংলাদেশে জারি আছে। এই প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দিতে হবে। 

ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, সমন্বয়কদের যেমন ছেড়ে দিয়েছেন, সকল শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের ছেড়ে দিতে হবে। সমস্ত দেশের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সরকারে বসেছেন। আমাদের সন্তানদের রক্তে রঞ্জিত করার জন্য আপনাদের ওইখানে বসিয়ে রাখা হয়নি। সমস্ত কারফিউ তুলে নেবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তুলে নেবেন। সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। তা আটকে রাখার অধিকার আপনাদের কারও নেই।

সরকারি সংস্থা উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, এখনো অনেক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আপনারা এটা বন্ধ করেন। যারা অপরাধ করেছে তাদের ধরেন। যারা হুকুমদাতা আমরা তাদের বিচার চাই। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আরিফ নূর বলেন, জুলাই মাসে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। পাশাপাশি প্রত্যেকটি হত্যার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, কিন্তু এই শাস্তি বর্তমান সরকারের কাছে নয়, পরবর্তীতে যে সরকার আসবে তাদের কাছে চাই। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের রুশাদ ফরিদী বলেন, আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আগামীকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিকাল ৩টায় দ্রোহ যাত্রা নামে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশে ছাত্র-শিক্ষক সুধী সমাজ অংশগ্রহণ করবেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠন এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম ইন বাংলাদেশের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন।

‘হত্যা’র বিচার চাইলেন শিল্পীরা:
ওদিকে রাজধানীর ফার্মগেটে আনন্দ সিনেমা হলের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও নানা মাধ্যমের কলাকুশলীরা। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের হত্যার বিচার দাবি করেন। গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমন প্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যার’ প্রতিবাদ জানান তারা। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে শিল্পীদের সমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশের বাধায় সেখানে করতে পারেননি তারা। ফার্মগেটের সমাবেশস্থলেও ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। 

জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী মোশারফ করিম বলেন, আমাদের দেশে যে অবস্থা বর্তমানে সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমরা ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থায় নেই। আমরা শান্তি চাই। রক্ত দেখতে চাই না। গোলাগুলি, রক্ত দেখতে চাই না। আমি ও আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা শান্তি চাই। জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, আমরা ভালো দিন দেখতে চাই। যেদিন থেকে গুলি চলেছে, সেদিন থেকেই আমরা মানসিকভাবে ভালো নেই। আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম। যারা মারা গেছে, তাদের হত্যার বিচার চাই।

ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক সিয়াম আহমেদ বলেন, আমার পক্ষ থেকে আলাদা করে কিছু বলার নেই। পুরো দেশের মানুষের একই কথা। দেশের মানুষ যখন একসঙ্গে কোনো ন্যায্য দাবি রাখে তখন সেটা একটু হলেও মাথায় আনা দরকার সেটা অবশ্যই ফেলে দেয়ার মতো নয়। তিনি বলেন, আমার যে ভাই এবং বোনটা মারা গেল আপনি যদি সুস্থ এবং স্বাভাবিক মানুষ হন তাহলে রাতে ঘুমাতে পারবেন না। আমার কানে এখনো বাজে, কারও পানি লাগবে? দেখুন কতো পানি আসছে এখন। এটা যতদিন মাথায় থাকবে ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না বাংলাদেশের মানুষ। আজকে ছাত্ররাই আমাদের মূল দর্শকশ্রোতা। যাদের আমাদের প্রয়োজন, আমরা যদি তাদের পক্ষ হয়ে না দাঁড়াতে পারি তাহলে কেন কাজ করলাম।

জনপ্রিয় পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, এই রাজনীতি, ভয়ের রাজনীতি, এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে রাজনীতি, যেভাবে গুলি করা হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল আরও আগে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন মামুনুর রশীদ, আকরাম খান, পিপলু আর খান, ঋতু সাত্তার, আমরিন মুসা, আশফাক নিপুণ, সুকর্ণ শাহেদসহ অনেকে। বৃষ্টির কারণে সবাই বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করেছেন। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন নির্মাতা নূরুল আলম আতিক, মাতিয়া বানু শুকু, রেদওয়ান রনি, তানিম নূর, নুহাশ হুমায়ূন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, আদনান আল রাজীব, শঙ্খ দাশ গুপ্ত, অভিনয়শিল্পী ইরেশ যাকের, জাকিয়া বারী মম, সুকর্ণ শাহেদ, মোস্তফা মনওয়ার, দিপু ইমাম, সাবিলা নূর, প্রবর রিপন, শ্যামল মাওলা, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা প্রমুখ। 
 

পাঠকের মতামত

সকল সাংবাদিক সম্প্রদায় সকল সত্য প্রচার করতে হবে ঈমানের , এটা একটি ঈমান পরীক্ষার পেশা।

Abid
২ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার, ৮:১৩ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status